Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman is the founder of the People's Republic of Bangladesh. He is the father of the Bangladeshi nation. We call him Jatir Jonok (Pita).
Saturday, 28 August 2010
PAKISTAN: Mujib’s Secret Trial
Monday, Aug. 23, 1971
PAKISTAN: Mujib’s Secret Trial
“Our people will react violently to this,” a member of the Bengali liberation underground whispered to TIME Correspondent David Greenway in Dacca last week. The warning proved all too true. Sheik Mujibur (“Mujib”) Rahman, 51, fiery leader of East Pakistan and the man who may hold the key to ending the bloody five-month-old civil war, had just gone on trial for his life before a secret military court in West Pakistan, more than 1,500 miles away. Late that same afternoon, a bomb exploded in the lobby of Dacca’s Intercontinental Hotel.
Flash and Roar. Correspondent Greenway, who suffered a concussion in the blast, cabled: “I was standing in front of the cigar store in the lobby when, with a flash and a roar, the wall a few feet in front of me seemed to buckle and dissolve. I was flung to the floor. That was fortunate, because great chunks of bricks and concrete flew over me, crashing through the lobby and blowing men and furniture through the plate-glass windows onto the sidewalk.
“Part of an air duct came down on my head and I could not move. There was thick, choking smoke and water spewing from broken pipes. Soon the smoke began to clear. People milled about the crumpled, crying victims lying bleeding on the lawn. None, luckily, was dead. One girl, an employee of the hotel, had been completely buried under three feet of rubble. When they dug her out, all she could say was: ‘I knew I should not have come to work today.’ ”
The timing of the bombing tends to confirm that Mujib’s trial will further stiffen Bengali resistance to the occupying West Pakistani army. If there are any chances of a political settlement —and they seem almost nonexistent—imposition of the death penalty could dash them.
Strict Secrecy. Mujib’s political role and his astonishing popularity in East Pakistan in a sense precipitated the civil war (TIME cover, Aug. 2). In last December’s elections for a constitutional assembly, his Awami League won an overwhelming 167 of 169 seats in the East. That was enough to guarantee Mujib a majority in the 313-seat national assembly, and ensured that he would have become Prime Minister of Pakistan. It was also enough to alarm President Agha Mohammed Yahya Khan and the West Pakistani establishment, which has run the geographically divided country since its partition from India in 1947.
Yahya and Co. feared that Mujib’s ascendancy would mean far greater autonomy for the long-exploited East Pakistanis, and the Pakistani army ruthlessly moved to crush the Bengali movement.
There is little doubt that Mujib will be convicted of the undefined charges of “waging war against Pakistan and other offenses.” When he was arrested last March 26, hours after the army crackdown, Yahya publicly branded him a traitor and hinted that he “might not live.” Observed one Western diplomat last week: “You know how hot the Punjabi plains are this time of year. You might say Mujib has a snowball’s chance of acquittal.”
Though everything about the trial is shrouded in secrecy, it was learned last week that the proceedings are being held in a new, one-story red-brick jail in the textile city of Lyallpur, 150 miles south of Rawalpindi. Islamabad sources claim that the strict secrecy is necessary to prevent Bengali rebels from trying to rescue Mujib. More likely it is because Yahya is unwilling to give
Mujib a public platform. When the sheik was tried in 1968, also on charges of treason stemming from his demands for East Pakistan’s autonomy, the trial was aborted amid widespread antigovernment protests. But not before Mujib’s British lawyer managed to make the government “look utterly silly,” as one diplomat recalled.
Second Home. A man of vitality and vehemence, Mujib became the political Gandhi of the Bengalis, symbolizing their hopes and voicing their grievances. Not even Pakistan’s founder, Mohammed Ali Jinnah, drew the million-strong throngs that Mujib has twice attracted in Dacca. Nor, for that matter, has any subcontinent politician since Gandhi’s day spent so much time behind bars for his political beliefs—a little over ten years. “Prison is my other home,” he once said.
If Mujib’s courage and bluntness got him into trouble frequently in the past, at least his family was spared. Now that is not so sure. Last week Mujib’s brother, a businessman named Sheik Abu Nasser, turned up in New Delhi with only the tattered clothes on his back. Nasser told how Mujib’s aged parents (his father is 95, his mother 80) were driven from their home by Pakistani troops. Their house was burned, their servants shot and they have not been heard from since. Nasser did not know whether his wife and six children were dead or alive. He had hoped, he said, that Senator Edward Kennedy, who last week visited India’s refugee camps on a fact-finding mission as chairman of the Senate Subcommittee on Refugees, might be able to learn their whereabouts. But the Pakistani government refused Kennedy permission to visit either East or West Pakistan. Kennedy, who trudged through mud and drenching rains, was greeted by refugees carrying hand-painted placards,
KENNEDY, THANK YOU FOR COMING.
He and an M.I.T. nutrition expert with him noted the appalling effects of malnutrition on the children, many already blind from vitamin A deficiencies, others irrevocably mentally retarded.
Though Mujib is accused of advocating secession for East Pakistan, the fact is that he did not want a total split-up of Pakistan and never declared independence until it was done in his name after the bloodbath began. To keep his young militants in line, he spoke of “emancipation” and “freedom.” “But there is no question of secession,” Mujib often said. “We only want our due share. Besides, East Pakistanis are in a majority, and it is ridiculous to think that the majority would secede from the minority.”
Yahya recently told a visitor, “My generals want a trial and execution.” Still, there is a feeling that Pakistan’s President might spare Mujib’s life. With hopes for a united Pakistan all but ended by the civil war, keeping Mujib alive would leave open one last option —negotiating the divorce of East and West in peace rather than war.
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বঙ্গবন্ধু................ওবায়দুল কাদের
জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমানচিত্রে অভ্যুদয়ের পর বাংলাদেশের ৪০ বছরের পথচলা নেহাত কম সময় নয়। বিক্ষোভ, বিতৃষ্ণা, বিবমিষার স্যাঁতসেঁতে দগদগে ঘায়ে প্রতিনিয়ত সংক্রমিত হচ্ছে অবর্ণনীয় ত্যাগ, সাধনা, সংগ্রাম, কষ্ট-ক্লেশে অর্জিত আমাদের স্বাধীন ভূখণ্ড। আমাদের রয়েছে অগণন রক্তাক্ত অতীত, স্মৃতি, আছে ইতিহাসের অনেকগুলো কালিমালিপ্ত অধ্যায়। ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও তৎপরবর্তী রাজনীতি জাতি হিসেবে আমাদের বিভক্তির দেয়ালকে অনতিক্রম্য উঁচু করে দিয়েছে। যারা সেদিন হত্যাকারী অপরাধী চক্রকে সংকটের ত্রাতায় পরিণত করার চেষ্টা করেছিল, ক্ষমতার চোখ রাঙিয়ে ইতিহাসকে রিমান্ডে নিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেছিল, ইতিহাসের পুনর্বয়ান, পুনর্লিখন ও পুনর্মূল্যায়নে তাদের মুখোশ আজ প্রায় উন্মোচিত। আমরা এখন জানি কাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে, কাদের পরোক্ষ মদদে এ জঘন্যতম, নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। ইতিহাসের এ পর্বের কে মীর জাফর, কে মিরণ, কে সেনাপতি ইয়ার লতিফ_ এ সত্য দিবালোকের মতো পরিষ্কার।
বেদনাবিধুর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় সেই ১৫ আগস্টে নরপিশাচ-ঘাতক দল অদম্য রক্তপিপাসু। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান ১০ বছরের শিশু রাসেল, শিশু আরিফ সেরনিয়াবাত, সুকান্ত আবদুল্লাহ রিন্টু কেউই তাদের বীভৎস ছোবল থেকে রেহাই পাননি। রেহাই পাননি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, আরজু মণি, বেবি সেরনিয়াবাতের মতো ঋজু, দৃঢ়, সাহসী, ক্রীড়ামোদী, সংস্কৃতবান নারী।
এখনও এখানে একুশে আগস্ট ঘটে। এখনও আইভি রহমানসহ অনেকের প্রাণের প্রদীপ নিভে যায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বর্বর হামলায়। এখনও অসংখ্য রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে থাকে মিছিলের সারি বিস্তৃত করে। এখনও বারুদ ঠাসা গ্রেনেড পিছু তাড়া করে ফেরে আমাদের রক্তমূল্যে অর্জিত গণতন্ত্রকে। বীরের বীরত্বগাথার পাশাপাশি বাংলার ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতারও। বারবার এখানে অবাঞ্ছিত সত্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে। রক্তাক্ত অতীতের প্রতি এক ধরনের আচ্ছন্নতা সরকারে, বিরোধী দলে আমাদের সমঝোতার সেতু তৈরির প্রধান বাধা। আমাদের এখানকার কোনো কোনো রাজনৈতিক দল, সেনা অরাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠে ভালো-মন্দের অবিমিশ্রিত কল্যাণকামী জাতীয় সংগঠন না হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পাকিস্তানের সেনানায়কদের মতো নিষ্ঠুর-নৃশংস ভিলেন থেকে গেছে। তাই এখানকার প্রতিযোগিতা, প্রতিরোধ নায়কে-নায়কে না হয়ে নায়কে-ভিলেনে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট থেকে ২০০৪-এর ২১ আগস্ট ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় একই সুতায় গাঁথা। অতীত কাতরতার এ রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি কি ভোলা যায় অবলীলায়?
বঙ্গবন্ধুর শিশুতোষ সারল্য, বাংলার মানুষের প্রতি অগাধ আস্থা-বিশ্বাস, তার সব সুকৃতি, তার অসামান্য জনপ্রিয়তা, তার আদর্শের ধ্রুবতা, তার প্রশ্নাতীত সততা সত্ত্বেও বিংশ শতাব্দীর কৌটিল্য কূটবুদ্ধি তাকে বাসন্তীর জালে জড়িয়ে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত করে সিঁড়িতে গড়িয়ে দেয়। আর তিনি নদী, মাঠ-ক্ষেত ভালোবেসে আবার ফিরে আসেন, রয়ে যান সব ধানসিঁড়ি নদীর তীরে।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পরপরই পাকিস্তানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী শক্তি দেশ ও বিদেশে তৎপর হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা রাখায় আরব দেশগুলো বাংলাদেশের পক্ষে কোনো প্রকার সহানুভূতি দেখায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সমাজতন্ত্রী দেশ সম্পর্কে যেসব দেশ ভিন্নমত পোষণ করত তারা প্রায় সবাই পাকিস্তানকে সমর্থন করে। ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সাহায্য করায় চীন তার মিত্র পাকিস্তানকে পুরো সমর্থন দেয়। জনসংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হলেও মুসলিম বিশ্বে তার অবস্থা ছিল চরমভাবে উপেক্ষিত। সেই মুসলিম বিশ্বের স্বীকৃতির সঙ্গে বিবদমান পক্ষ পাকিস্তানের স্বীকৃতি নিয়ে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক।
স্বাধীনতার পরপরই সব ভারতীয় সৈন্যের ফিরে যাওয়া এবং '৭৪-এ বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান সফরের পর পাকিস্তানের স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও ঐক্যবুদ্ধির পরিচয় দেয়। দীর্ঘমেয়াদি কৌশল এবং বাংলাদেশের জনগণের শান্তি ও স্বস্তির কথা চিন্তা করে বঙ্গবন্ধুকে অনেক আপাত বিতর্কিত অথচ দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন। সেখানে তিনি বলেন, 'পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণের জন্য আমরা কোনো উদ্যোগ বাদ দেই নাই এবং সবশেষে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দিকে ক্ষমা প্রদর্শন করিয়া আমরা চূড়ান্ত অবদান রাখিয়াছি। এ সকল যুদ্ধবন্দি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসহ মারাত্মক? অপরাধ করিয়াছে। ইহা হইতেছে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ও উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ শান্তি ও স্থায়িত্ব গড়িয়া তোলার পথে আমাদের অবদান। এ কাজ করিতে গিয়া আমরা কোনো পূর্বশর্তারোপ অথবা কোনো দর কষাকষি করি নাই। আমরা কেবলমাত্র আমাদের জনগণের ভবিষ্যৎ মঙ্গলের কল্পনায় প্রভাবিত হইয়াছি।' পাকিস্তানের স্বীকৃতির পরই বাংলাদেশ সম্পর্কে সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্ব এবং চীনের অবস্থান নমনীয় হয়। দুটি রাষ্ট্রেরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রক্রিয়া চলতে থাকে। যদিও এ দুটি রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রানুরাগী ছিলেন। নজরুল ছিলেন তার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্রোহের মডেল। জেল জীবনে তিনি প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তেন। গাইতেন : 'নাই নাই ভয়/হবে হবে জয়', 'আমার সোনার বাংলা...', আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি', 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে' জাতীয় গান। নজরুলের 'কারার ঐ লৌহ কপাট', দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে' তাকে ব্যাপক আলোড়িত করত। তার রাষ্ট্রচিন্তা ও রাষ্ট্রবিনির্মাণের সাধনা শুধু যে এসব কাব্যসঙ্গীত প্রেরণানির্ভর ছিল তা নয়; বাঙালির সেক্যুলার সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রসাধনা সম্পর্কে তিনি ছাত্রজীবনেই আলোড়িত হন। আকৃষ্ট হন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি।
বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র যখন কুখ্যাত হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলন করেন, সেই আন্দোলনের অন্যতম সাহসী সৈনিক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, ফকির মজুন শাহ, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীন, নূরল দিন, সূর্যসেন, চারণকবি মুকুন্দ দাশ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হক, আবুল হাশিম, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুও তার প্রেরণা ছিল।
বংশ, বিদ্যা, বুদ্ধি ও বিত্তের ওপর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অনেকটা নির্ভর করে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে এসবের বিশেষ ভূমিকা ছিল না। বংশ এবং বিত্তে তিনি টুঙ্গিপাড়ার উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান নয়। সে সময়ের হিসেবে মধ্যবিত্ত। বুদ্ধির চেয়েও তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল বিস্ময়কর। একবার নাইজেরিয়ার জেনারেল ইয়াকুবু গাওয়ান বঙ্গবন্ধুকে বলেন, 'অবিভক্ত পাকিস্তান একটি শক্তিশালী দেশ, কেন আপনি দেশটাকে ভেঙে দিলেন।' উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'শুনুন মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আপনার কথাই হয়তো ঠিক। অবিভক্ত পাকিস্তান হয়তো শক্তিশালী ছিল, তার চেয়েও শক্তিশালী হয়তো হতো অবিভক্ত ভারত। কিন্তু সেসবের চেয়ে শক্তিশালী হতো সংঘবদ্ধ এশিয়া। আর মহাশক্তিশালী হতো একজোট এ বিশ্বটি। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি, সবকিছু চাইলেই কি পাওয়া যায়?
বিদ্যার্জনে বঙ্গবন্ধু বারবার বাধা পান। অসুস্থতায় পাঠ বিরতির ফলে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন বিলম্বে। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে রাজনীতিতে জড়িয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য ও আবুল হাশিমের ভাবশিষ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৪৭-এ ইংরেজ উপনিবেশ বিমুক্তি তথা দেশভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু ভাষার অধিকারের সংগ্রামে সভা-সমিতি এবং শোভাযাত্রা-হরতাল সংগঠনের অভিযোগে ১৯৪৮-এর মার্চ ও সেপ্টেম্বরে দু'বার তাকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধস্তন কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে ১৯৪৯ সালে মার্চ মাসে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। সে সময় কয়েকজন আন্দোলনকারী ভবিষ্যৎ সৎ আচরণের মুচলেকা দিয়ে তাদের বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করলেও বঙ্গবন্ধু কোনো মুচলেকা না দেওয়ায় তার বহিষ্কারাদেশ বহাল থাকে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতার কোনো বিরতি ছিল না। পাকিস্তান সরকারের ২৪ বছর শাসনকালে তাকে ১৮ বার কারাগারে বন্দি রাখা হয়। তার এ বন্দিত্বের সময়সীমা ১২ বছরেরও বেশি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তার প্রাণদণ্ড হওয়ার কথা ছিল। তবে আইয়ুব-ইয়াহিয়া যা পারেনি স্বাধীন বাংলাদেশে ঘাতক বাঙালিরাই তা সাধন করেছে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে।
ভিক্টর হুগো বলেছেন, 'নতুন সময় নতুন চিন্তাকে অনিবার্য করে তোলে।' তাই সবকিছুর পরও সব অবিশ্বাস-সংশয়ের দেয়াল সরিয়ে আমাদের সমঝোতার পথে, ঐক্যবুদ্ধির পথে চলতে হবে। কেননা অপার ক্ষমাশীল বঙ্গবন্ধু সবকিছুর পরও এ পথেই চলতে চেয়েছেন। আলিঙ্গন করেছেন মৃত্যুকে। তার অস্বাভাবিক মহাপ্রয়াণ দিবসে আমরা আর শোক না করে সৌজন্য তোরণের অসৌজন্যতা বাদ দিয়ে আসুন স্মরণ করি তার আজন্ম সাধনার মহামূল্যবান কীর্তিকে। এখনও তিনি বাংলার দুর্জয় তারুণ্যের হিমালয়, দুর্যোগের অমানিশায় উজ্জ্বল বাতিঘর। যতদিন এ বাংলার চন্দ্র-সূর্য উদয় হবে ততদিন ভোরের শুকতারার মতোই বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বঙ্গবন্ধু আমাদের রোল মডেল।
বেদনাবিধুর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় সেই ১৫ আগস্টে নরপিশাচ-ঘাতক দল অদম্য রক্তপিপাসু। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান ১০ বছরের শিশু রাসেল, শিশু আরিফ সেরনিয়াবাত, সুকান্ত আবদুল্লাহ রিন্টু কেউই তাদের বীভৎস ছোবল থেকে রেহাই পাননি। রেহাই পাননি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, আরজু মণি, বেবি সেরনিয়াবাতের মতো ঋজু, দৃঢ়, সাহসী, ক্রীড়ামোদী, সংস্কৃতবান নারী।
এখনও এখানে একুশে আগস্ট ঘটে। এখনও আইভি রহমানসহ অনেকের প্রাণের প্রদীপ নিভে যায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বর্বর হামলায়। এখনও অসংখ্য রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে থাকে মিছিলের সারি বিস্তৃত করে। এখনও বারুদ ঠাসা গ্রেনেড পিছু তাড়া করে ফেরে আমাদের রক্তমূল্যে অর্জিত গণতন্ত্রকে। বীরের বীরত্বগাথার পাশাপাশি বাংলার ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতারও। বারবার এখানে অবাঞ্ছিত সত্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে। রক্তাক্ত অতীতের প্রতি এক ধরনের আচ্ছন্নতা সরকারে, বিরোধী দলে আমাদের সমঝোতার সেতু তৈরির প্রধান বাধা। আমাদের এখানকার কোনো কোনো রাজনৈতিক দল, সেনা অরাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠে ভালো-মন্দের অবিমিশ্রিত কল্যাণকামী জাতীয় সংগঠন না হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পাকিস্তানের সেনানায়কদের মতো নিষ্ঠুর-নৃশংস ভিলেন থেকে গেছে। তাই এখানকার প্রতিযোগিতা, প্রতিরোধ নায়কে-নায়কে না হয়ে নায়কে-ভিলেনে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট থেকে ২০০৪-এর ২১ আগস্ট ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় একই সুতায় গাঁথা। অতীত কাতরতার এ রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি কি ভোলা যায় অবলীলায়?
বঙ্গবন্ধুর শিশুতোষ সারল্য, বাংলার মানুষের প্রতি অগাধ আস্থা-বিশ্বাস, তার সব সুকৃতি, তার অসামান্য জনপ্রিয়তা, তার আদর্শের ধ্রুবতা, তার প্রশ্নাতীত সততা সত্ত্বেও বিংশ শতাব্দীর কৌটিল্য কূটবুদ্ধি তাকে বাসন্তীর জালে জড়িয়ে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত করে সিঁড়িতে গড়িয়ে দেয়। আর তিনি নদী, মাঠ-ক্ষেত ভালোবেসে আবার ফিরে আসেন, রয়ে যান সব ধানসিঁড়ি নদীর তীরে।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পরপরই পাকিস্তানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী শক্তি দেশ ও বিদেশে তৎপর হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা রাখায় আরব দেশগুলো বাংলাদেশের পক্ষে কোনো প্রকার সহানুভূতি দেখায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সমাজতন্ত্রী দেশ সম্পর্কে যেসব দেশ ভিন্নমত পোষণ করত তারা প্রায় সবাই পাকিস্তানকে সমর্থন করে। ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সাহায্য করায় চীন তার মিত্র পাকিস্তানকে পুরো সমর্থন দেয়। জনসংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হলেও মুসলিম বিশ্বে তার অবস্থা ছিল চরমভাবে উপেক্ষিত। সেই মুসলিম বিশ্বের স্বীকৃতির সঙ্গে বিবদমান পক্ষ পাকিস্তানের স্বীকৃতি নিয়ে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক।
স্বাধীনতার পরপরই সব ভারতীয় সৈন্যের ফিরে যাওয়া এবং '৭৪-এ বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান সফরের পর পাকিস্তানের স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও ঐক্যবুদ্ধির পরিচয় দেয়। দীর্ঘমেয়াদি কৌশল এবং বাংলাদেশের জনগণের শান্তি ও স্বস্তির কথা চিন্তা করে বঙ্গবন্ধুকে অনেক আপাত বিতর্কিত অথচ দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন। সেখানে তিনি বলেন, 'পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণের জন্য আমরা কোনো উদ্যোগ বাদ দেই নাই এবং সবশেষে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দিকে ক্ষমা প্রদর্শন করিয়া আমরা চূড়ান্ত অবদান রাখিয়াছি। এ সকল যুদ্ধবন্দি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসহ মারাত্মক? অপরাধ করিয়াছে। ইহা হইতেছে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ও উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ শান্তি ও স্থায়িত্ব গড়িয়া তোলার পথে আমাদের অবদান। এ কাজ করিতে গিয়া আমরা কোনো পূর্বশর্তারোপ অথবা কোনো দর কষাকষি করি নাই। আমরা কেবলমাত্র আমাদের জনগণের ভবিষ্যৎ মঙ্গলের কল্পনায় প্রভাবিত হইয়াছি।' পাকিস্তানের স্বীকৃতির পরই বাংলাদেশ সম্পর্কে সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্ব এবং চীনের অবস্থান নমনীয় হয়। দুটি রাষ্ট্রেরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রক্রিয়া চলতে থাকে। যদিও এ দুটি রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রানুরাগী ছিলেন। নজরুল ছিলেন তার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্রোহের মডেল। জেল জীবনে তিনি প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তেন। গাইতেন : 'নাই নাই ভয়/হবে হবে জয়', 'আমার সোনার বাংলা...', আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি', 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে' জাতীয় গান। নজরুলের 'কারার ঐ লৌহ কপাট', দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে' তাকে ব্যাপক আলোড়িত করত। তার রাষ্ট্রচিন্তা ও রাষ্ট্রবিনির্মাণের সাধনা শুধু যে এসব কাব্যসঙ্গীত প্রেরণানির্ভর ছিল তা নয়; বাঙালির সেক্যুলার সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রসাধনা সম্পর্কে তিনি ছাত্রজীবনেই আলোড়িত হন। আকৃষ্ট হন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি।
বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র যখন কুখ্যাত হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলন করেন, সেই আন্দোলনের অন্যতম সাহসী সৈনিক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, ফকির মজুন শাহ, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীন, নূরল দিন, সূর্যসেন, চারণকবি মুকুন্দ দাশ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হক, আবুল হাশিম, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুও তার প্রেরণা ছিল।
বংশ, বিদ্যা, বুদ্ধি ও বিত্তের ওপর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অনেকটা নির্ভর করে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে এসবের বিশেষ ভূমিকা ছিল না। বংশ এবং বিত্তে তিনি টুঙ্গিপাড়ার উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান নয়। সে সময়ের হিসেবে মধ্যবিত্ত। বুদ্ধির চেয়েও তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল বিস্ময়কর। একবার নাইজেরিয়ার জেনারেল ইয়াকুবু গাওয়ান বঙ্গবন্ধুকে বলেন, 'অবিভক্ত পাকিস্তান একটি শক্তিশালী দেশ, কেন আপনি দেশটাকে ভেঙে দিলেন।' উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'শুনুন মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আপনার কথাই হয়তো ঠিক। অবিভক্ত পাকিস্তান হয়তো শক্তিশালী ছিল, তার চেয়েও শক্তিশালী হয়তো হতো অবিভক্ত ভারত। কিন্তু সেসবের চেয়ে শক্তিশালী হতো সংঘবদ্ধ এশিয়া। আর মহাশক্তিশালী হতো একজোট এ বিশ্বটি। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি, সবকিছু চাইলেই কি পাওয়া যায়?
বিদ্যার্জনে বঙ্গবন্ধু বারবার বাধা পান। অসুস্থতায় পাঠ বিরতির ফলে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন বিলম্বে। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে রাজনীতিতে জড়িয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য ও আবুল হাশিমের ভাবশিষ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৪৭-এ ইংরেজ উপনিবেশ বিমুক্তি তথা দেশভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু ভাষার অধিকারের সংগ্রামে সভা-সমিতি এবং শোভাযাত্রা-হরতাল সংগঠনের অভিযোগে ১৯৪৮-এর মার্চ ও সেপ্টেম্বরে দু'বার তাকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধস্তন কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে ১৯৪৯ সালে মার্চ মাসে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। সে সময় কয়েকজন আন্দোলনকারী ভবিষ্যৎ সৎ আচরণের মুচলেকা দিয়ে তাদের বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করলেও বঙ্গবন্ধু কোনো মুচলেকা না দেওয়ায় তার বহিষ্কারাদেশ বহাল থাকে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতার কোনো বিরতি ছিল না। পাকিস্তান সরকারের ২৪ বছর শাসনকালে তাকে ১৮ বার কারাগারে বন্দি রাখা হয়। তার এ বন্দিত্বের সময়সীমা ১২ বছরেরও বেশি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তার প্রাণদণ্ড হওয়ার কথা ছিল। তবে আইয়ুব-ইয়াহিয়া যা পারেনি স্বাধীন বাংলাদেশে ঘাতক বাঙালিরাই তা সাধন করেছে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে।
ভিক্টর হুগো বলেছেন, 'নতুন সময় নতুন চিন্তাকে অনিবার্য করে তোলে।' তাই সবকিছুর পরও সব অবিশ্বাস-সংশয়ের দেয়াল সরিয়ে আমাদের সমঝোতার পথে, ঐক্যবুদ্ধির পথে চলতে হবে। কেননা অপার ক্ষমাশীল বঙ্গবন্ধু সবকিছুর পরও এ পথেই চলতে চেয়েছেন। আলিঙ্গন করেছেন মৃত্যুকে। তার অস্বাভাবিক মহাপ্রয়াণ দিবসে আমরা আর শোক না করে সৌজন্য তোরণের অসৌজন্যতা বাদ দিয়ে আসুন স্মরণ করি তার আজন্ম সাধনার মহামূল্যবান কীর্তিকে। এখনও তিনি বাংলার দুর্জয় তারুণ্যের হিমালয়, দুর্যোগের অমানিশায় উজ্জ্বল বাতিঘর। যতদিন এ বাংলার চন্দ্র-সূর্য উদয় হবে ততদিন ভোরের শুকতারার মতোই বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বঙ্গবন্ধু আমাদের রোল মডেল।
বঙ্গবন্ধু ॥ কালে কালান্তরে-------আবদুল লতিফ সিদ্দিকী
ইতিহাস-প্রসঙ্গে মহাভারতের একটি উক্তি আমার মনে আলোকসম্পাত করে একটু ভিন্ন-রকম কৌণিকতায় এবং কালের কটাক্ষে তার একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ উপযোগিতা আবিষ্কার সম্ভব। সংস্কৃতে আমার দখল নেই, প্রবেশাধিকার কিংবা গেটপাসও কখনো পাইনি, পেতে চেষ্টা করিনি। অনুবাদের এঁটোকাটা চেখে না দেখে এ-অবস্থায় উপায়ান্তর কী! বেশ, তাহলে তো ভাষান্তরের ভান্ডার থেকে রসদ হাতিয়ে নেওয়াই সহজ। পরিহাস এই ঞযব ষধসঢ় ড়ভ যরংঃড়ৎু ফবংঃৎড়ুং ঃযব ফধৎশহবংং ড়ভ রমহড়ৎধহপব মহাভারতের বাণী আমার হাতে পৌছে পেঙ্গুইন বুকস প্রকাশিত ঝধসব-ঝবী খড়াব রহ ওহফরধ : অ খরঃবৎধৎু ঐরংঃড়ৎু নামক গ্রন্থের আলঙ্কারিক সংযোজন-সূত্র ধরে। এই দীর্ঘ ভণিতা অকারণ নয়'ইতিহাসের আলোকবর্তিকা' শব্দযুগ্মের উচ্চারণমাত্র গুঞ্জরিত আলোর প্রতিভাস যেমন শাশ্বত সত্যের মতো মনোলোকে সঞ্চারিত, 'মাতৃকা'র ইতিহাস-সংস্কৃতি যে হাল-সুরতে বহাল দেখি তাতে ফধৎশহবং ড়ভ রমহড়ৎধহপব কথাটির ব্যঞ্জনা সবকিছু ঘোলাটে করতে চায়। এটা এজন্য যে, বঙ্গবন্ধু-হত্যা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে হিড়িক-পড়া ইতিহাস-বিকৃতির বিরোধিতায় জ্ঞানতত্ত্ব তথা ঃযব ষধসঢ় ড়ভ যরংঃড়ৎু-এর স্মরণ জরুরি।
যে-কালে বঙ্গবন্ধুর জন্ম, বিকাশ ও প্রস্থান তা ঐতিহাসিক প্রামাণিকতার প্রতিকূল নয় কোনো অর্থেই, তারপরও তাঁর বিষয়ে, বিশেষত তাঁর বিপক্ষে চালিত হত্যা-অভিযান সম্পর্কে এত বিতর্ক-বিসংবাদ কেন, এত গলদ-প্রবাহের কারণ কী, সে বিষয়ে তথ্যপাত ও যুক্তি-নিরীক্ষণই বর্তমান নিবন্ধের উপলক্ষ। কথাবার্তায়, আলাপচারিতায়, বোলচালে, তর্ক-বিস্তারে সাধ্যমতো সংক্ষিপ্ত হওয়ারও যে চেষ্টা করবো, সে বিষয়টিও বলে রাখি।
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ মহাকালের এমন-এক স্টেশন যা আজ থেকে মাত্র ছত্রিশ বছর আগে ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি ধ্বংসাত্মক পলক ফেলে, যাতে সবার জানা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। যে-সময়ে তিনি বাস করছিলেন তা কী তাঁর ওপর এতটা ক্ষিপ্ত হয় যে তাঁর প্রাণহরণ সময়ের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে? প্রমাণ অসম্ভব নয় যে, সময় তার নিজের গতিতে ছিলো না, স্বাধীনতাবিরোধী প্রেতাত্মা তার কালো ডানা কালের ওপর বিস্তৃত করে তার স্বাভাবিকতাকে হরণ করে। তাই আগস্ট পঁচাত্তর বঙ্গবন্ধুর জন্য ছিল অশনিসঙ্কেত। প্রশ্ন উঠবে সময়ের ওপর যারা কর্তৃত্বের স্পর্ধা রাখে ওরা কারা, ওদের খুঁটির গোড়া কোথায় এবং ওরা তাহলে নমস্য কি-না। নমস্য অবশ্যই নয়। ওরা চিহ্নিত বিশ্বাসঘাতক এবং ঘাতকতার শক্তি বাড়াতে শয়তানের সহযোগিতা গ্রহণকারী। মনে রাখা দরকার, ওরা সেই শয়তান শ্রেণীগোষ্ঠী যার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আজীবন যুদ্ধ করে বিজয়ী হন। যুদ্ধে তিনি যে-নীতি অবলম্বন করেন, সত্য বটে, প্রশাসনে তা করেননি তিনি ক্ষমা করেছিলেন। শয়তান এই হাতিয়ারটি হাতে তুলে নিয়ে তার অপব্যবহারে মেতে ওঠে। তাঁকে নির্দয়-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। এ-হত্যায় তিনি বিজয়ী, হত্যাকারীরা বিজিত। কারণ তিনি ছিলেন সত্যপক্ষ, আর ওরা মিথ্যাবাদী ঘাতক, ইতিহাসের খড়কুটো মাত্র।
আধুনিক জীবন-বীক্ষায় নারী ও শিশুর প্রতি বিশেষ সংবেদ প্রদর্শিত হয়ে থাকে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু-পরিবারের নারী-শিশু সেদিন নূ্ন্যতম মানবিক অনুকম্পা থেকেও বঞ্চিত হয়। শিশু রাসেল তার কী দোষ? দোষ তবু তার ছিলো বঙ্গবন্ধুর রক্ত কেন তার ধমনীতে, শিরা-উপশিরায়, কেন সে সত্যের অধিকার এমন কি তাঁর উত্তরাধিকারের সম্ভাবনা বহন করবে? অভিশপ্ত ঘাতকচক্রের নিকট হুমকি বা প্রতিপক্ষ প্রতিপন্ন হয়েছে সে। এ-থেকে তাদের ষড়যন্ত্রের লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। ক্ষমতার প্রলোভন তাদের স্খলন ও বিপথগামিতার মুখ্য কারণ না হলে রাসেলের মতো অবুঝ শিশুসন্তানের প্রতি অমন নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের প্রয়োজন পড়বে কেন? বঙ্গবন্ধু-পরিবারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শূন্যতার চোরাবালিতে আটকে দিয়ে ক্ষমতার খোলনলচে পাল্টে দেওয়াই ছিলো তাদের উদ্দেশ্য এভাবেই ছক মোতাবেক তারা সর্বোচ্চ ফায়দা লুটে নেওয়ার ফন্দি করেই অভিযান চালায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো একেবারেই আলাদা ধাতের মানুষ, যেটা পর্যবেক্ষকবৃন্দের অজানা নয়। ঐ-একদিনের বিচ্ছিন্ন (যদিও তা অবিচ্ছিন্ন, বৃহৎ অর্থে) নৃশংসতায় হারিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি পৃথিবীতে আসেননি। এজন্য তাঁকে বাঁচতে হয়েছে, তীব্রভাবে তিনি বেচে আছেন, আঘাতের ক্ষতস্থানকে ফুলে এবং সৌরভে রূপান্তরিত করে, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত এবং.....
প্রেমের অনুভূতির মধ্যে মানবিক নিরাপত্তার প্রত্যাশা সুশীল-সভ্য মানুষের জন্য এক স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বঙ্গবন্ধুর সংবেদনশীল হৃদয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতি মমতা-নিবিষ্ট প্রেম ও দেশমাতৃকার মঙ্গলের প্রতি স্বনিষ্ঠ ভালবাসা সঞ্চিত ছিল বলেই সশস্ত্র নিরাপত্তার বিষয়টিকে আনুষ্ঠানিকতা ও ঐতিহ্যিক উপায়-পন্থা হিসেবেই দেখেছেন। তা না হলে অস্ত্রের নিরাপত্তাকেই তিনি হৃদয়বৃত্তিক নিরাপত্তার উপরে ঠাঁই দিতে পারতেন। ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর সড়কের নিরাপত্তা বেষ্টনী হতে পারত অধিকতর দুর্ভেদ্য ও দূরতিক্রম্যতা যে হয়নি তার পেছনে বঙ্গবন্ধুর মানবিক রোমান্টিকতা ও প্রেমিকসুলভ ঔদাসীন্য কিছুমাত্রায় দায়ী। জাতিসত্তার মর্যাদার সঙ্গে জড়িত একটি জাতির সার্বভৌম বিচার-পদ্ধতি। কিন্তু ঘাতকগোষ্ঠীর আরোপিত কুখ্যাত 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' বিচারিক স্বতঃস্ফূর্ততায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ১৫-আগস্ট হত্যাকান্ডকে ক্রমপ্রবাহিত এক নৃশংস নাট্যযজ্ঞে রূপ দেয়। ১২ জুন ১৯৯৬-এর নির্বাচনী বিজয়ের দামন ধরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পরিচালিত সরকার মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় ১২ নভেম্বর ১৯৯৬ কুখ্যাত ইনডেমনিটি বিল বাতিলের মাধ্যমে জালেমের যাঁতাকল সরিয়ে দিয়ে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর কুখ্যাত পনের খুনিকে প্রকাশ্য ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধু-হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে।
সকাল যেমন রশ্মির চারু রেখায় পুরো দিবসের সমস্ত সম্ভাবনা ফুটিয়ে তোলে, বঙ্গবন্ধুর শৈশব তেমনি তাঁর উত্তরকালের জীবনছবি অবলীলায় মেলে ধরে। টুঙ্গিপাড়ার 'খোকা' শেখ লুৎফর রহমান ও সাহারা খাতুনের সাংসারিক গ-ি পেরিয়ে বিশ্বসংসারের বৃহৎ পরিসরে আবির্ভূত। বেরিবেরি রোগের প্রহারে তাঁর চোখে যে অপারেশন হয়, তাতে তাঁর দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে পারত। আসলে তা না হয়ে দৃষ্টিশক্তি আরো বেড়ে যায় সেদিন থেকেই যেন তাঁর দূরদৃষ্টির দুয়ার খুলতে শুরু। স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি চুঁইয়ে পড়ার সমস্যা সমাধানে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদীর্র নিকট আর্জি পেশ, পাকিস্তান আন্দোলনে একাত্মতা, নিখিল-ভারত মুসলীম লীগ ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুথ শ্রেণীর কর্মচারীদের অধিকার-আদায় আন্দোলনে নেতৃত্বদান প্রভৃতি ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁর বৃহৎ জীবনের সঙ্কেত স্পষ্টতর হয়ে উঠতে থাকে। জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে যা-কিছু তিনি করেন, যা কিছু তিনি করান, যা-কিছু তিনি বরণ করেন, যা-কিছু প্রত্যাখ্যান করেন তাঁর মধ্য দিয়ে তিনি মৃত্যুকে উপেক্ষা করতে শেখেন। ঘাতকচক্র এ-গরমিলের সত্যটি বুঝে উঠতে পারেনি। তাই হত্যা করে ওরা তাঁকে অমরত্বের পথে একধাপ এগিয়ে দেয়।
স্বাধীনতা-যুদ্ধে তাঁর আক্ষরিক ও প্রতীকী সেনাপতিত্ব, প্রশাসনে তাঁর সংস্কার-চিন্তা ও বাস্তবায়ন-প্রচেষ্টা, দেশ-মানবতার প্রতি অকুণ্ঠ প্রেম, সমতা ও সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে তাঁর উদার ইহজাগতিকতার সবুজ-সঙ্কেত, তস্কর-লুণ্ঠিত মাতৃকার পুনর্গঠন ও দ্বিতীয় বিপ্লবের অভীক্ষায় উন্নয়ন-অভিযান প্রভৃতি দুঃসাহসিকতার চাপ জাতির কতিপয় কুলাঙ্গার যে সইতে পারেনি তা কী তাঁকে ক্ষুদ্রতার গন্ডিতে পুরতে পেরেছে! তাঁর দেশ-পরিচালন পর্বে যা-কিছু তাদের দেখতে হয়েছে তার জন্য তারা, যদি ধরে নিই প্রস্তুত ছিলো না, তাহলে তাদের কি উচিত ছিল না এমন এক রাজনৈতিক পন্থা বাতলে দেওয়া যা সকল অর্থে বঙ্গবন্ধু-অবলম্বিত উপায়াদর্শ অপেক্ষা শ্রেয়তর?
নতুন রাষ্ট্রে তখন বৈশ্বিক গোয়েন্দা চক্রের আনাগোনা, পরাজিত পাকিস্তান আদর্শের প্রেতাত্মার চোরাগোপ্তা বিচরণ, আদর্শচ্যুত মুক্তিযোদ্ধার উৎপাতসহ নানা দুর্বল লক্ষণ জাতিকে তখন অতিক্রম করতে হয়। এমন একটি সময়ে যুদ্ধক্লান্ত যুবশক্তি ও কারাদন্ডিত সেনাপতির স্থিতির ঘাটতি কী করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি প্রাচুর্যময় জাতি-সংহতি উপহার দেওয়া সম্ভব? প্রশাসনিক নেতৃত্বের প্রশ্নে বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে তখন শ্রেয়তর বিকল্প কি কেউ দেখিয়ে দিতে পারত? বঙ্গবন্ধুর ঐ বিশাল ব্যক্তিত্ব ও প্রবাদপ্রতিম জনপ্রিয়তার বিপরীতে শক্ত-পায়ে সোজা দাঁড়িয়ে নিজেকে বিকল্প নেতৃত্বরূপে হাজির করার স্পর্ধা যদি একটিমাত্র বাঙালির মনে থাকা সম্ভব হতো তাহলে না হয় তাঁর শাসনভার গ্রহণের বিপক্ষে যুক্তির অবকাশ থাকতে পারত।
সমাজের গুণগত উত্তরণ ও মহৎ-প্রতিভার মধ্যে পারস্পরিকতার অনুপাত বিসদৃশ হলে সমাজের চালু সংস্কৃতি-পরম্পরা প্রায়ই তার আত্মীকরণে অক্ষম। সমাজ আধার, ব্যক্তি আধেয়। আধারের স্বাস্থ্য ও প্রসারতা প্রমিত না হলে আধেয় তার পূর্ণ স্বরূপ প্রদর্শনে স্বস্তি বোধ করে না। আধেয় হিসেবে বঙ্গবন্ধু আধারের প্রতিবন্ধিত্ব ও প্রতিবন্ধকতা একই সঙ্গে মোকাবিলা করেন। প্রসঙ্গক্রমে তক্ষশীলার কূটরাজনীতিবিশারদ কৌটিল্যের স্মরণ নেওয়া যায়। ভারত-ভূমির ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-দার্শনিক ইতিবৃত্ত খতিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয় ভারত-রাজনীতির তত্ত্বাদর্শে চাণক্যই একমাত্র মৌলিক পুরুষ; উত্তরকালে যারা রাজনৈতিক চিনত্মাদর্শনে বিশিষ্ট অভিধা পেয়েছেন তারা সবাই ইউরোপের আদলে ও আদর্শে চালিত। একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য, চাণক্য তত্ত্বের জহুরি মাত্র, প্রয়োগের পুরোধা তিনি নন। বঙ্গবন্ধু তত্ত্ব ও প্রয়োগ উভয়েরই প্রাণপুরুষ।
চাণক্য-তত্ত্বযুগ পেছনে ফেলে সুপরিসর ভারত-ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এসেছেন নতুন তাপস-তত্ত্বে ও প্রয়োগে। তারা কেউ কৌটিল্যের জটিল মানস-লক্ষণ ও কূটনৈতিক ধী-শক্তি অতিক্রম করতে পারেননি। চাণক্যের পর বঙ্গবন্ধুই ভারত-উপমহাদেশের একমাত্র পুরুষ যিনি ভারত-চিন্তার স্বকীয়তা ও সার্বভৌম স্বভাব অক্ষত রেখে তত্ত্বে ও প্রয়োগে অভিনবত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তাঁর জাতিরাষ্ট্র-জন্ম-সাফল্যের দিকে দৃষ্টিপাতে গ্রহণশীলতার ঔদার্য যদি একটু বাড়াতে পারি তাহলে বলা যাবে, এশিয়ার বৃহৎ পটভূমিতে তাঁর সমতুল্য আদর্শ-পুরুষ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব, যার মধ্যে একসঙ্গে এত জীবনশক্তির প্রকাশ ও কার্যকর লোকমঙ্গলের দৃষ্টান্ত লভ্য।
যে-কালে বঙ্গবন্ধুর জন্ম, বিকাশ ও প্রস্থান তা ঐতিহাসিক প্রামাণিকতার প্রতিকূল নয় কোনো অর্থেই, তারপরও তাঁর বিষয়ে, বিশেষত তাঁর বিপক্ষে চালিত হত্যা-অভিযান সম্পর্কে এত বিতর্ক-বিসংবাদ কেন, এত গলদ-প্রবাহের কারণ কী, সে বিষয়ে তথ্যপাত ও যুক্তি-নিরীক্ষণই বর্তমান নিবন্ধের উপলক্ষ। কথাবার্তায়, আলাপচারিতায়, বোলচালে, তর্ক-বিস্তারে সাধ্যমতো সংক্ষিপ্ত হওয়ারও যে চেষ্টা করবো, সে বিষয়টিও বলে রাখি।
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ মহাকালের এমন-এক স্টেশন যা আজ থেকে মাত্র ছত্রিশ বছর আগে ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি ধ্বংসাত্মক পলক ফেলে, যাতে সবার জানা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। যে-সময়ে তিনি বাস করছিলেন তা কী তাঁর ওপর এতটা ক্ষিপ্ত হয় যে তাঁর প্রাণহরণ সময়ের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে? প্রমাণ অসম্ভব নয় যে, সময় তার নিজের গতিতে ছিলো না, স্বাধীনতাবিরোধী প্রেতাত্মা তার কালো ডানা কালের ওপর বিস্তৃত করে তার স্বাভাবিকতাকে হরণ করে। তাই আগস্ট পঁচাত্তর বঙ্গবন্ধুর জন্য ছিল অশনিসঙ্কেত। প্রশ্ন উঠবে সময়ের ওপর যারা কর্তৃত্বের স্পর্ধা রাখে ওরা কারা, ওদের খুঁটির গোড়া কোথায় এবং ওরা তাহলে নমস্য কি-না। নমস্য অবশ্যই নয়। ওরা চিহ্নিত বিশ্বাসঘাতক এবং ঘাতকতার শক্তি বাড়াতে শয়তানের সহযোগিতা গ্রহণকারী। মনে রাখা দরকার, ওরা সেই শয়তান শ্রেণীগোষ্ঠী যার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আজীবন যুদ্ধ করে বিজয়ী হন। যুদ্ধে তিনি যে-নীতি অবলম্বন করেন, সত্য বটে, প্রশাসনে তা করেননি তিনি ক্ষমা করেছিলেন। শয়তান এই হাতিয়ারটি হাতে তুলে নিয়ে তার অপব্যবহারে মেতে ওঠে। তাঁকে নির্দয়-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। এ-হত্যায় তিনি বিজয়ী, হত্যাকারীরা বিজিত। কারণ তিনি ছিলেন সত্যপক্ষ, আর ওরা মিথ্যাবাদী ঘাতক, ইতিহাসের খড়কুটো মাত্র।
আধুনিক জীবন-বীক্ষায় নারী ও শিশুর প্রতি বিশেষ সংবেদ প্রদর্শিত হয়ে থাকে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু-পরিবারের নারী-শিশু সেদিন নূ্ন্যতম মানবিক অনুকম্পা থেকেও বঞ্চিত হয়। শিশু রাসেল তার কী দোষ? দোষ তবু তার ছিলো বঙ্গবন্ধুর রক্ত কেন তার ধমনীতে, শিরা-উপশিরায়, কেন সে সত্যের অধিকার এমন কি তাঁর উত্তরাধিকারের সম্ভাবনা বহন করবে? অভিশপ্ত ঘাতকচক্রের নিকট হুমকি বা প্রতিপক্ষ প্রতিপন্ন হয়েছে সে। এ-থেকে তাদের ষড়যন্ত্রের লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। ক্ষমতার প্রলোভন তাদের স্খলন ও বিপথগামিতার মুখ্য কারণ না হলে রাসেলের মতো অবুঝ শিশুসন্তানের প্রতি অমন নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের প্রয়োজন পড়বে কেন? বঙ্গবন্ধু-পরিবারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শূন্যতার চোরাবালিতে আটকে দিয়ে ক্ষমতার খোলনলচে পাল্টে দেওয়াই ছিলো তাদের উদ্দেশ্য এভাবেই ছক মোতাবেক তারা সর্বোচ্চ ফায়দা লুটে নেওয়ার ফন্দি করেই অভিযান চালায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো একেবারেই আলাদা ধাতের মানুষ, যেটা পর্যবেক্ষকবৃন্দের অজানা নয়। ঐ-একদিনের বিচ্ছিন্ন (যদিও তা অবিচ্ছিন্ন, বৃহৎ অর্থে) নৃশংসতায় হারিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি পৃথিবীতে আসেননি। এজন্য তাঁকে বাঁচতে হয়েছে, তীব্রভাবে তিনি বেচে আছেন, আঘাতের ক্ষতস্থানকে ফুলে এবং সৌরভে রূপান্তরিত করে, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত এবং.....
প্রেমের অনুভূতির মধ্যে মানবিক নিরাপত্তার প্রত্যাশা সুশীল-সভ্য মানুষের জন্য এক স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বঙ্গবন্ধুর সংবেদনশীল হৃদয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতি মমতা-নিবিষ্ট প্রেম ও দেশমাতৃকার মঙ্গলের প্রতি স্বনিষ্ঠ ভালবাসা সঞ্চিত ছিল বলেই সশস্ত্র নিরাপত্তার বিষয়টিকে আনুষ্ঠানিকতা ও ঐতিহ্যিক উপায়-পন্থা হিসেবেই দেখেছেন। তা না হলে অস্ত্রের নিরাপত্তাকেই তিনি হৃদয়বৃত্তিক নিরাপত্তার উপরে ঠাঁই দিতে পারতেন। ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর সড়কের নিরাপত্তা বেষ্টনী হতে পারত অধিকতর দুর্ভেদ্য ও দূরতিক্রম্যতা যে হয়নি তার পেছনে বঙ্গবন্ধুর মানবিক রোমান্টিকতা ও প্রেমিকসুলভ ঔদাসীন্য কিছুমাত্রায় দায়ী। জাতিসত্তার মর্যাদার সঙ্গে জড়িত একটি জাতির সার্বভৌম বিচার-পদ্ধতি। কিন্তু ঘাতকগোষ্ঠীর আরোপিত কুখ্যাত 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' বিচারিক স্বতঃস্ফূর্ততায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ১৫-আগস্ট হত্যাকান্ডকে ক্রমপ্রবাহিত এক নৃশংস নাট্যযজ্ঞে রূপ দেয়। ১২ জুন ১৯৯৬-এর নির্বাচনী বিজয়ের দামন ধরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পরিচালিত সরকার মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় ১২ নভেম্বর ১৯৯৬ কুখ্যাত ইনডেমনিটি বিল বাতিলের মাধ্যমে জালেমের যাঁতাকল সরিয়ে দিয়ে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর কুখ্যাত পনের খুনিকে প্রকাশ্য ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধু-হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে।
সকাল যেমন রশ্মির চারু রেখায় পুরো দিবসের সমস্ত সম্ভাবনা ফুটিয়ে তোলে, বঙ্গবন্ধুর শৈশব তেমনি তাঁর উত্তরকালের জীবনছবি অবলীলায় মেলে ধরে। টুঙ্গিপাড়ার 'খোকা' শেখ লুৎফর রহমান ও সাহারা খাতুনের সাংসারিক গ-ি পেরিয়ে বিশ্বসংসারের বৃহৎ পরিসরে আবির্ভূত। বেরিবেরি রোগের প্রহারে তাঁর চোখে যে অপারেশন হয়, তাতে তাঁর দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে পারত। আসলে তা না হয়ে দৃষ্টিশক্তি আরো বেড়ে যায় সেদিন থেকেই যেন তাঁর দূরদৃষ্টির দুয়ার খুলতে শুরু। স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি চুঁইয়ে পড়ার সমস্যা সমাধানে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদীর্র নিকট আর্জি পেশ, পাকিস্তান আন্দোলনে একাত্মতা, নিখিল-ভারত মুসলীম লীগ ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুথ শ্রেণীর কর্মচারীদের অধিকার-আদায় আন্দোলনে নেতৃত্বদান প্রভৃতি ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁর বৃহৎ জীবনের সঙ্কেত স্পষ্টতর হয়ে উঠতে থাকে। জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে যা-কিছু তিনি করেন, যা কিছু তিনি করান, যা-কিছু তিনি বরণ করেন, যা-কিছু প্রত্যাখ্যান করেন তাঁর মধ্য দিয়ে তিনি মৃত্যুকে উপেক্ষা করতে শেখেন। ঘাতকচক্র এ-গরমিলের সত্যটি বুঝে উঠতে পারেনি। তাই হত্যা করে ওরা তাঁকে অমরত্বের পথে একধাপ এগিয়ে দেয়।
স্বাধীনতা-যুদ্ধে তাঁর আক্ষরিক ও প্রতীকী সেনাপতিত্ব, প্রশাসনে তাঁর সংস্কার-চিন্তা ও বাস্তবায়ন-প্রচেষ্টা, দেশ-মানবতার প্রতি অকুণ্ঠ প্রেম, সমতা ও সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে তাঁর উদার ইহজাগতিকতার সবুজ-সঙ্কেত, তস্কর-লুণ্ঠিত মাতৃকার পুনর্গঠন ও দ্বিতীয় বিপ্লবের অভীক্ষায় উন্নয়ন-অভিযান প্রভৃতি দুঃসাহসিকতার চাপ জাতির কতিপয় কুলাঙ্গার যে সইতে পারেনি তা কী তাঁকে ক্ষুদ্রতার গন্ডিতে পুরতে পেরেছে! তাঁর দেশ-পরিচালন পর্বে যা-কিছু তাদের দেখতে হয়েছে তার জন্য তারা, যদি ধরে নিই প্রস্তুত ছিলো না, তাহলে তাদের কি উচিত ছিল না এমন এক রাজনৈতিক পন্থা বাতলে দেওয়া যা সকল অর্থে বঙ্গবন্ধু-অবলম্বিত উপায়াদর্শ অপেক্ষা শ্রেয়তর?
নতুন রাষ্ট্রে তখন বৈশ্বিক গোয়েন্দা চক্রের আনাগোনা, পরাজিত পাকিস্তান আদর্শের প্রেতাত্মার চোরাগোপ্তা বিচরণ, আদর্শচ্যুত মুক্তিযোদ্ধার উৎপাতসহ নানা দুর্বল লক্ষণ জাতিকে তখন অতিক্রম করতে হয়। এমন একটি সময়ে যুদ্ধক্লান্ত যুবশক্তি ও কারাদন্ডিত সেনাপতির স্থিতির ঘাটতি কী করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি প্রাচুর্যময় জাতি-সংহতি উপহার দেওয়া সম্ভব? প্রশাসনিক নেতৃত্বের প্রশ্নে বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে তখন শ্রেয়তর বিকল্প কি কেউ দেখিয়ে দিতে পারত? বঙ্গবন্ধুর ঐ বিশাল ব্যক্তিত্ব ও প্রবাদপ্রতিম জনপ্রিয়তার বিপরীতে শক্ত-পায়ে সোজা দাঁড়িয়ে নিজেকে বিকল্প নেতৃত্বরূপে হাজির করার স্পর্ধা যদি একটিমাত্র বাঙালির মনে থাকা সম্ভব হতো তাহলে না হয় তাঁর শাসনভার গ্রহণের বিপক্ষে যুক্তির অবকাশ থাকতে পারত।
সমাজের গুণগত উত্তরণ ও মহৎ-প্রতিভার মধ্যে পারস্পরিকতার অনুপাত বিসদৃশ হলে সমাজের চালু সংস্কৃতি-পরম্পরা প্রায়ই তার আত্মীকরণে অক্ষম। সমাজ আধার, ব্যক্তি আধেয়। আধারের স্বাস্থ্য ও প্রসারতা প্রমিত না হলে আধেয় তার পূর্ণ স্বরূপ প্রদর্শনে স্বস্তি বোধ করে না। আধেয় হিসেবে বঙ্গবন্ধু আধারের প্রতিবন্ধিত্ব ও প্রতিবন্ধকতা একই সঙ্গে মোকাবিলা করেন। প্রসঙ্গক্রমে তক্ষশীলার কূটরাজনীতিবিশারদ কৌটিল্যের স্মরণ নেওয়া যায়। ভারত-ভূমির ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-দার্শনিক ইতিবৃত্ত খতিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয় ভারত-রাজনীতির তত্ত্বাদর্শে চাণক্যই একমাত্র মৌলিক পুরুষ; উত্তরকালে যারা রাজনৈতিক চিনত্মাদর্শনে বিশিষ্ট অভিধা পেয়েছেন তারা সবাই ইউরোপের আদলে ও আদর্শে চালিত। একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য, চাণক্য তত্ত্বের জহুরি মাত্র, প্রয়োগের পুরোধা তিনি নন। বঙ্গবন্ধু তত্ত্ব ও প্রয়োগ উভয়েরই প্রাণপুরুষ।
চাণক্য-তত্ত্বযুগ পেছনে ফেলে সুপরিসর ভারত-ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এসেছেন নতুন তাপস-তত্ত্বে ও প্রয়োগে। তারা কেউ কৌটিল্যের জটিল মানস-লক্ষণ ও কূটনৈতিক ধী-শক্তি অতিক্রম করতে পারেননি। চাণক্যের পর বঙ্গবন্ধুই ভারত-উপমহাদেশের একমাত্র পুরুষ যিনি ভারত-চিন্তার স্বকীয়তা ও সার্বভৌম স্বভাব অক্ষত রেখে তত্ত্বে ও প্রয়োগে অভিনবত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তাঁর জাতিরাষ্ট্র-জন্ম-সাফল্যের দিকে দৃষ্টিপাতে গ্রহণশীলতার ঔদার্য যদি একটু বাড়াতে পারি তাহলে বলা যাবে, এশিয়ার বৃহৎ পটভূমিতে তাঁর সমতুল্য আদর্শ-পুরুষ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব, যার মধ্যে একসঙ্গে এত জীবনশক্তির প্রকাশ ও কার্যকর লোকমঙ্গলের দৃষ্টান্ত লভ্য।
রক্তঝরা মার্চ : ফিরে দেখা---- তোফায়েল আহমেদ
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ভাষণের পর ৮ মার্চ থেকে দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশ পরিচালিত হতে থাকে। এই প্রথমবারের মতো বাংলার মানুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে চলতে শুরু করলো। বঙ্গবন্ধু তাই বাংলার মানুষকে গর্ব করে বলছেন, 'আজ ভাবতে আমার কত ভালো লাগে, আজ একটি সুন্দর ধর্মঘট পালিত হচ্ছে। আজ বাংলার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আজ এই প্রথম বাঙালিরা প্রথমবার নিজেদের শাসনভার নিজেদের হাতে গ্রহণ করেছে।' আমরা যারা তরুণ, তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন - গ্রামে গ্রামে যাও, যেটা তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল- আমরা সেই নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করেছি। তিনি আরো বলেছিলেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। আমরা তাঁর নির্দেশে প্রত্যেক গ্রামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদও গড়ে তুলেছি। এবং বিভিন্ন জায়গায় আমরা অস্ত্রের ট্রেনিং নিতে শুরু করলাম। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি গ্রামে মানুষ হাতিয়ার তুলে নিয়েছে অর্থাৎ ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ একটি নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে একটি সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেছে। আর সেই কার্যক্রম ৮ মার্চ থেকেই শুরু হয়। এভাবেই ৮, ৯ ও ১০ মার্চ থেকে আমরা ২৫ মার্চ পর্যন্ত আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছি এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা আমাদেরকে সংগঠিত করেছি।
আমাদের মধ্যে চারজন- শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু যুব সমাজ ও ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার জন্য। আমরা সেই দায়িত্ব পালন করেছি। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু যারা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা তাদেরকে সংগঠিত করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল ওসমানীকে । এ কাজের সঙ্গে আমাকে যুক্ত হওয়ার বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এভাবে আমরা একেকজন একেক দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।
আমাদের যে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ- নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আসম আব্দুর রব এবং আব্দুল কুদ্দুস মাখন সারা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করতে শুরু করলো। আজকে যখন ভাবি আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি হানাদারমুক্ত হয়েছে, স্বাধীন হয়েছে-আমার মনে পড়ে '৬৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টনের জনসভার কথা। সেদিন আমরা বলেছিলাম, 'শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করবো, শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মাগো তোমায় মুক্ত করবো।' ভাবতে কত ভালো লাগে '৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়েছেন। আর ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে নিরস্ত্র জাতি সশস্ত্র জাতি হয়ে উঠেছে। হাতিয়ার দিয়ে যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর বাংলা মা-কে আমরা মুক্ত করেছি। এই মুক্তির আন্দোলনের প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরদিন থেকে সমস্ত বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, এক সুতায় নিজেদের গেঁথেছে।
আমাদের মধ্যে চারজন- শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু যুব সমাজ ও ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার জন্য। আমরা সেই দায়িত্ব পালন করেছি। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু যারা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা তাদেরকে সংগঠিত করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল ওসমানীকে । এ কাজের সঙ্গে আমাকে যুক্ত হওয়ার বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এভাবে আমরা একেকজন একেক দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।
আমাদের যে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ- নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আসম আব্দুর রব এবং আব্দুল কুদ্দুস মাখন সারা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করতে শুরু করলো। আজকে যখন ভাবি আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি হানাদারমুক্ত হয়েছে, স্বাধীন হয়েছে-আমার মনে পড়ে '৬৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টনের জনসভার কথা। সেদিন আমরা বলেছিলাম, 'শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করবো, শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মাগো তোমায় মুক্ত করবো।' ভাবতে কত ভালো লাগে '৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়েছেন। আর ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে নিরস্ত্র জাতি সশস্ত্র জাতি হয়ে উঠেছে। হাতিয়ার দিয়ে যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর বাংলা মা-কে আমরা মুক্ত করেছি। এই মুক্তির আন্দোলনের প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরদিন থেকে সমস্ত বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, এক সুতায় নিজেদের গেঁথেছে।
সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ সকলেই স্ব-স্ব অবস্থান থেকে প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হতে থাকেন। এ ক'দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলার জনগণকে দায়ী করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এদিন বেতারে ভাষণ দেন। ৫ মার্চ ইয়াহিয়া এবং জনাব ভুট্টো ৫ ঘন্টা গোপনে বৈঠক করে যে খসড়া তৈরি করেছিলেন বক্তৃতায় সেটিই প্রতিফলিত হয়। এদিন ঢাকাসহ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়।
পূর্ব প্রেক্ষাপট
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় এসে ১২ ও ১৩ জানুয়ারি এই দুই দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দু'দফা আলোচনায় মিলিত হন। আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান, "আলোচনা সন্তোষজনক হয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট খুব শীঘ্রই ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে সম্মত হয়েছেন।" অপরদিকে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তেজগাঁও বিমানবন্দরে জেনারেল ইয়াহিয়া সাংবাদিকদের বলেন, "দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তাঁর সঙ্গে আলোচনা সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন তা পুরোপুরি সঠিক।" ঢাকা থেকে ফিরে ইয়াহিয়া খান লারকানায় ভুট্টোর বাসভবনে যান এবং সেখানে জেনারেলদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। মূলত লারকানা বৈঠকেই নির্বাচনী ফলাফল বানচালের নীল নকশা প্রণীত হয়। অতঃপর জানুয়ারির শেষ দিকে ভুট্টো তার দলবলসহ ঢাকায় আসেন এবং জানুয়ারির ২৭ ও ২৮ তারিখে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান এবং শাসনতন্ত্র ৬ দফা ভিত্তিক হবে বলে জানান। আর ভুট্টো বলেন, 'আরো আলোচনার প্রয়োজন' এবং তিনি ফেব্রুয়ারির শেষদিকের আগে পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের বিরোধিতা করেন। এরপর ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে এক সরকারী ঘোষণায় জানানো হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ৩ মার্চ বুধবার ৯টায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছেন। এদিকে ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। ওয়ার্কিং কমিটি আলোচনা অনুমোদন করে এবং বঙ্গবন্ধুকে "জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অধিকার আদায়ের জন্য যেকোন পন্থা গ্রহণের পূর্ণ অধিকার প্রদান করে।" ১৫ ফেব্রুয়ারি ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু চক্রান্তকারীদের এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দেন যে, "ফ্যাসিস্ট পন্থা পরিহার করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগুরুর শাসন মেনে নিয়ে দেশের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখুন। জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যবস্থা বানচাল করার যেকোন উদ্দেশে তৎপর গণতান্ত্রিক রায় নস্যাৎকারিগণ আগুন নিয়ে খেলবেন না।"
তিনি আরো বলেন, "দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দেওয়া অধিকারবলে আমরা ৬ দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবো। সাত কোটি বাঙালির বুকে মেশিনগান বসিয়েও কেউ ঠেকাতে পারবা না।" অন্যদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে, "আওয়ামী লীগের ৬ দফার ব্যাপারে আপোষ বা পুনর্বিন্যাসের আশ্বাস পাওয়া না গেলে তার দল জাতীয় পরিষদের আসন্ন ঢাকা অধিবেশনে যোগদান করতে পারবে না।" ১৭ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো তার পার্টি অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন শুরু হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে পিপল্স পার্টির জন্য তাতে যোগদান করা একেবারেই অর্থহীন।" এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো তার সহকর্মিদের উদ্দেশে বলেন, "আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি ও সেনাবাহিনী_ দেশে এই তিনটি শক্তিই আছে, আমরা কোন চতুর্থ শক্তির কথা স্বীকার করি না।" জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে অস্বীকার জ্ঞাপন করলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার জন্য ভুট্টোকে আমন্ত্রণ জানান। ১৯ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে ৫ ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সম্ভবত ১৭ জানুয়ারি লারকানা বৈঠক এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকেই বাঙালি হত্যার চক্রান্ত ও নীলনকশা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। পিন্ডি থেকে করাচি ফিরে গিয়ে ভুট্টো স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, "জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোন ইচ্ছা তাঁর নেই।" ক্রমেই এটা স্বতঃস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পাকিস্তানের সামরিক চক্র '৭০-এর নির্বাচনে বাঙালির অকুণ্ঠ রায়কে বানচাল করার জন্যে ভুট্টোকে ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করছে এবং জনাব ভুট্টো নিজেও সানন্দে ব্যবহূত হচ্ছেন।
ঘটনার ধারাবাহিকতায় দেখা যায় যে, ৭০-এর নির্বাচনের ঐতিহাসিক রায় বানচালের ষড়যন্ত্র যতই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, বঙ্গবন্ধু ততই কঠোর-কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে এগুচ্ছিলেন। ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়হিয়া খান তার মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেন এবং পিন্ডিতে গভর্নর-সামরিক প্রশাসকদের নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। ঐ বৈঠকে লারকানা ও রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করা হয়। সামরিক চক্রের সাথে মিলে ভুট্টো যে ভূমিকায় লিপ্ত তাতে এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কোনভাবেই বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এবং ১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এহেন বক্তব্যে তাৎক্ষণিক ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরী। ৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে, শাসনতন্ত্র তৈরী করার জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে মিলিত হবে, জনমনে কাঙ্ক্ষিত এরকম একটি অভিপ্রায়কে সমাধিস্থ করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণায় দাবানলের মতো জ্বলে উঠলো বাংলার মানুষ, তারা ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়লো।
১ মার্চ ১৯৭১
ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা অনুযায়ী বাংলার মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য ৭১-এর ১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ইয়াহিয়া খান তার ভাষণে বলেন, "আমি আমাদের জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের তারিখ ৩ মার্চ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলাম। বিগত কয়েক সপ্তাহে অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমাকে দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, ঐকমত্যে পেঁৗছবার পরিবর্তে আমাদের কোন কোন নেতা অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। সংক্ষেপে বলতে গেলে পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, অর্থাৎ পাকিস্তান পিপল্স পার্টি এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া ভারত-সৃষ্ট উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সার্বিক অবস্থাকে আরো জটিল করে তুলেছে। অতএব আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান পরবতর্ী কোন তারিখের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।" সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে কোনরূপ আলোচনা ব্যতিরেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক একতরফাভাবে ঘোষিত এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে বাংলার মানুষ ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
এদিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সভায় ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয়ে শেস্নাগানে শেস্নাগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তুলছিল। তখন বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, "অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণায় সারা দেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। আমি মর্মাহত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। সংগ্রাম করেই মুক্তি আনবো। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন।" পরে এক সংবাদ সম্মেলনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রাথমিক কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং বলেন, "৬ মার্চ পর্যন্ত সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল আর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পরবতর্ী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। বিকাল ৩ টায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পল্টন ময়দানের স্বতঃস্ফূর্ত জনসভায় যোগদান করি। সেখানে আমি আমার বক্তৃতায় বলি, "আর ৬ দফা ও ১১ দফা নয়। এবার বাংলার মানুষ ১ দফার সংগ্রাম শুরু করবে। আর এই ১ দফা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আজ আমরাও শপথ নিলাম_ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।" শত-সহস্র মিছিলে জনসমুদ্রে পরিণত হলো পল্টন ময়দান। প্রতিবাদ সভায় আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশ মতো আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ডেকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন। নেতার নির্দেশ পেয়ে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সর্বজনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আসম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক বৈঠকে বিকেলে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে 'স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করে। একমাত্র ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দই সব ধরনের ঝুঁকির মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নেয়।
২ মার্চ ১৯৭১
এদিন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় এবং তাঁর নির্দেশে সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এ পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব প্রদান করেন ছাত্রলীগ সভাপতি জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক জনাব শাজাহান সিরাজ, ডাকসু সহ-সভাপতি জনাব আসম আব্দুর রব এবং সাধারণ সম্পাদক জনাব আব্দুল কুদ্দুস মাখন। পরে এ পতাকা নিয়ে আন্দোলিত রাজপথ মুখর হয়ে ওঠে শেস্নাগানে শেস্নাগানে, 'জাগো জাগো, বাঙালি জাগো'; 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা'; 'স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব'; 'বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে'; 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি'; 'তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ'; 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, সোনার বাংলা মুক্ত করো'; 'পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা'; 'পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা'; 'ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'; 'স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ছাত্র নেতৃবৃন্দের বিশাল একটি মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সমবেত হয়। এদিন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিতে ২ জন নাগরিক প্রাণ হারানোর সংবাদে বঙ্গবন্ধু তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি প্রদান করেন এবং ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে অর্ধদিবস হরতালের কর্মসূচী ঘোষণা করেন।
সামরিক কর্তৃপক্ষ সান্ধ্য আইন জারি করলে জনতা তা অমান্য করে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর কুশপুত্তলিকা দাহ করে রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং সেনাবাহিনী বিনা উস্কানিতে গুলিবর্ষণ করলে নগরীর বিভিন্ন স্থানে মিছিল সহিংস হয়ে ওঠে।
৩ মার্চ ১৯৭১
এদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি জনাব নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জনাব শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। ইশতেহারে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়। জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচিত করা হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি" গানটি। লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ অনুষ্ঠানটি ছিল আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এক উলেস্নখযোগ্য দিন। এদিনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে তাঁর বক্তৃতায় অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবী করেন। আর জনতার উদ্দেশে অফিস-আদালত বন্ধ রেখে, খাজনা-ট্যাক্স না দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। এদিনের ঐতিহাসিক সভায় আমার বক্তৃতায়ও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের প্রতিধ্বনি করে কর্মসূচী সফল করতে দেশবাসির প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই। এদিন বাংলার মাটি শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়। চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলীতে ৭১ জন নিহত হয়। সারাদেশ অগি্নগর্ভ হয়ে ওঠে।
৪ মার্চ ১৯৭১
এদিনও বঙ্গবন্ধু ঘোষিত পূর্ব কর্মসূচী অনুযায়ী সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ঢাকায় সাময়িকভাবে কারফিউ তুলে নেওয়া হলেও চট্টগ্রাম, খুলনা ও রংপুরে তা বলবৎ থাকে। খুলনায় হরতাল পালনকালে নিরস্ত্র জনতার উপর সেনাবাহিনীর বিক্ষিপ্ত গুলীবর্ষণে ৬ জন নিহত হয় ও ২২ জন আহত হয়। চট্টগ্রামে এদিনও সেনাবাহিনীর গুলীবর্ষণে গতকাল আর আজ মিলে সর্বমোট ১২০ জন নিহত ও ৩৩৫ জন আহত হয়। সারাদেশে আহতদের সুচিকিৎসার্থে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শত সহস্র মানুষ লাইন দিয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান করে। ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও নিহতদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরকম উত্তাল পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে আওয়ামী লীগের এক মুলতবী সভায় ভবিষ্যৎ কর্মসূচী ব্যাখ্যা করে সংগ্রামের নুতন দিক-নির্দেশনায় বলেন, "আজ আওয়ামী লীগ নয়, গোটা বাঙালি জাতিই অগি্ন-পরীক্ষার সম্মুখীন। আমাদের সামনে আজ দু'টো পথ খোলা আছে। একটি সর্বাত্মক ত্যাগ স্বীকারের জন্য নিজেদের মনোবল অটুট রেখে অবিচলভাবে পূর্ণ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া অথবা ভুট্টো-ইয়াহিয়ার কথামত সব কিছু মেনে নেওয়া।" নিজের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "আপনারা জানেন, আমি সারা জীবন ক্ষমতার মসনদ তুচ্ছ জ্ঞান করে দেশ ও জাতির কাছে আমার জীবন মর্টগেজ রেখেছি। বাংলার মানুষ গুলী খেয়ে বন্দুকের নলের কাছে বুক পেতে দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফাঁসি কাষ্ঠ থেকে আমাকে মুক্ত করে এনেছে। আমার ৬ দফা কর্মসূচীর প্রতি ম্যান্ডেট দিয়েছে। এখন শহীদের পবিত্র আত্মত্যাগের প্রতি অশ্রদ্ধা জানিয়ে পাকিস্তানীদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে অবমাননাকর শর্তে কী করে ক্ষমতায় যাই?" অতঃপর বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের মধ্যে সারাদেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাঠামো তৈরির নির্দেশ প্রদান করেন। এদিনের উলেস্নখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের নুতন নামকরণ করেন 'ঢাকা বেতার কেন্দ্র'। পাকিস্তান টেলিভিশনের নাম পাল্টে 'ঢাকা টেলিভিশন' নাম দিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতে থাকে। কার্যত সারা বাংলা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে।
৫ মার্চ ১৯৭১
এদিন হরতাল কর্মসূচী পালনকালে টঙ্গীতে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে ৬ জন নিহত ও ৩৫ জন আহত হন। খুলনা ও রাজশাহীতেও যথাক্রমে ২ জন ও ১ জন নিহত হন। টঙ্গীতে ২০ হাজারেরও বেশী শ্রমিক স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিক্ষোভ মিছিল বের করলে সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলীবর্ষণ করে। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিকালে আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম থেকে এক বিশাল লাঠি মিছিল বের হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে ব্যাংকিং লেনদেনের ওপর নুতন নির্দেশ দেওয়া হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ এদিন চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেট ও দেশের অন্যান্য স্থানে সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের চিত্র তুলে ধরেন। যে কোন জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আওয়ামী লীগ একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে। এদিন তাহরিক-ই-ইশতিকলাল পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল (অবঃ) আসগর খান পাকিস্তানের সংহতি বিপন্ন উলেস্নখ করে অবিলম্বে শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান।
৬ মার্চ ১৯৭১
সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বিগত কয়েকদিনে সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ সকলেই স্ব-স্ব অবস্থান থেকে প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হতে থাকেন। এ ক'দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলার জনগণকে দায়ী করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এদিন বেতারে ভাষণ দেন। ৫ মার্চ ইয়াহিয়া এবং জনাব ভুট্টো ৫ ঘন্টা গোপনে বৈঠক করে যে খসড়া তৈরি করেছিলেন বক্তৃতায় সেটিই প্রতিফলিত হয়। এদিন ঢাকাসহ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙ্গে ৩৪১ জন কারাবন্দী পলায়নকালে পুলিশের গুলিতে ৭ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও 'খ' অঞ্চলের সামরিক শাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে সরিয়ে তদস্থলে 'বেলুচিস্তানের কসাই'খ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে উভয় পদে নিযুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এয়ার মাশর্াল আসগর খান বঙ্গবন্ধুর সাথে দ্বিতীয় দফা বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, "পরিস্থিতি রক্ষায় আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। বাকি বিষয় আগামীকাল শেখ মুজিবের বক্তৃতায় জানতে পারবেন।" কার্যত, সারাদেশের মানুষ এদিন থেকে অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে পরবতর্ী দিকনির্দেশনা জানার। এদিন আমি এক বিবৃতিতে ৭ মার্চের ভাষণ রেসকোর্স থেকে সরাসরি প্রচারের জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানাই।
পূর্ব প্রেক্ষাপট
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় এসে ১২ ও ১৩ জানুয়ারি এই দুই দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দু'দফা আলোচনায় মিলিত হন। আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান, "আলোচনা সন্তোষজনক হয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট খুব শীঘ্রই ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে সম্মত হয়েছেন।" অপরদিকে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তেজগাঁও বিমানবন্দরে জেনারেল ইয়াহিয়া সাংবাদিকদের বলেন, "দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তাঁর সঙ্গে আলোচনা সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন তা পুরোপুরি সঠিক।" ঢাকা থেকে ফিরে ইয়াহিয়া খান লারকানায় ভুট্টোর বাসভবনে যান এবং সেখানে জেনারেলদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। মূলত লারকানা বৈঠকেই নির্বাচনী ফলাফল বানচালের নীল নকশা প্রণীত হয়। অতঃপর জানুয়ারির শেষ দিকে ভুট্টো তার দলবলসহ ঢাকায় আসেন এবং জানুয়ারির ২৭ ও ২৮ তারিখে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান এবং শাসনতন্ত্র ৬ দফা ভিত্তিক হবে বলে জানান। আর ভুট্টো বলেন, 'আরো আলোচনার প্রয়োজন' এবং তিনি ফেব্রুয়ারির শেষদিকের আগে পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের বিরোধিতা করেন। এরপর ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে এক সরকারী ঘোষণায় জানানো হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ৩ মার্চ বুধবার ৯টায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছেন। এদিকে ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। ওয়ার্কিং কমিটি আলোচনা অনুমোদন করে এবং বঙ্গবন্ধুকে "জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অধিকার আদায়ের জন্য যেকোন পন্থা গ্রহণের পূর্ণ অধিকার প্রদান করে।" ১৫ ফেব্রুয়ারি ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু চক্রান্তকারীদের এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দেন যে, "ফ্যাসিস্ট পন্থা পরিহার করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগুরুর শাসন মেনে নিয়ে দেশের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখুন। জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যবস্থা বানচাল করার যেকোন উদ্দেশে তৎপর গণতান্ত্রিক রায় নস্যাৎকারিগণ আগুন নিয়ে খেলবেন না।"
তিনি আরো বলেন, "দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দেওয়া অধিকারবলে আমরা ৬ দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবো। সাত কোটি বাঙালির বুকে মেশিনগান বসিয়েও কেউ ঠেকাতে পারবা না।" অন্যদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে, "আওয়ামী লীগের ৬ দফার ব্যাপারে আপোষ বা পুনর্বিন্যাসের আশ্বাস পাওয়া না গেলে তার দল জাতীয় পরিষদের আসন্ন ঢাকা অধিবেশনে যোগদান করতে পারবে না।" ১৭ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো তার পার্টি অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন শুরু হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে পিপল্স পার্টির জন্য তাতে যোগদান করা একেবারেই অর্থহীন।" এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো তার সহকর্মিদের উদ্দেশে বলেন, "আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি ও সেনাবাহিনী_ দেশে এই তিনটি শক্তিই আছে, আমরা কোন চতুর্থ শক্তির কথা স্বীকার করি না।" জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে অস্বীকার জ্ঞাপন করলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার জন্য ভুট্টোকে আমন্ত্রণ জানান। ১৯ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে ৫ ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সম্ভবত ১৭ জানুয়ারি লারকানা বৈঠক এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকেই বাঙালি হত্যার চক্রান্ত ও নীলনকশা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। পিন্ডি থেকে করাচি ফিরে গিয়ে ভুট্টো স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, "জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোন ইচ্ছা তাঁর নেই।" ক্রমেই এটা স্বতঃস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পাকিস্তানের সামরিক চক্র '৭০-এর নির্বাচনে বাঙালির অকুণ্ঠ রায়কে বানচাল করার জন্যে ভুট্টোকে ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করছে এবং জনাব ভুট্টো নিজেও সানন্দে ব্যবহূত হচ্ছেন।
ঘটনার ধারাবাহিকতায় দেখা যায় যে, ৭০-এর নির্বাচনের ঐতিহাসিক রায় বানচালের ষড়যন্ত্র যতই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, বঙ্গবন্ধু ততই কঠোর-কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে এগুচ্ছিলেন। ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়হিয়া খান তার মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেন এবং পিন্ডিতে গভর্নর-সামরিক প্রশাসকদের নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। ঐ বৈঠকে লারকানা ও রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করা হয়। সামরিক চক্রের সাথে মিলে ভুট্টো যে ভূমিকায় লিপ্ত তাতে এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কোনভাবেই বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এবং ১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এহেন বক্তব্যে তাৎক্ষণিক ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরী। ৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে, শাসনতন্ত্র তৈরী করার জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে মিলিত হবে, জনমনে কাঙ্ক্ষিত এরকম একটি অভিপ্রায়কে সমাধিস্থ করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণায় দাবানলের মতো জ্বলে উঠলো বাংলার মানুষ, তারা ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়লো।
১ মার্চ ১৯৭১
ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা অনুযায়ী বাংলার মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য ৭১-এর ১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ইয়াহিয়া খান তার ভাষণে বলেন, "আমি আমাদের জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের তারিখ ৩ মার্চ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলাম। বিগত কয়েক সপ্তাহে অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমাকে দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, ঐকমত্যে পেঁৗছবার পরিবর্তে আমাদের কোন কোন নেতা অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। সংক্ষেপে বলতে গেলে পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, অর্থাৎ পাকিস্তান পিপল্স পার্টি এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া ভারত-সৃষ্ট উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সার্বিক অবস্থাকে আরো জটিল করে তুলেছে। অতএব আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান পরবতর্ী কোন তারিখের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।" সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে কোনরূপ আলোচনা ব্যতিরেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক একতরফাভাবে ঘোষিত এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে বাংলার মানুষ ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
এদিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সভায় ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয়ে শেস্নাগানে শেস্নাগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তুলছিল। তখন বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, "অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণায় সারা দেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। আমি মর্মাহত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। সংগ্রাম করেই মুক্তি আনবো। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন।" পরে এক সংবাদ সম্মেলনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রাথমিক কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং বলেন, "৬ মার্চ পর্যন্ত সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল আর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পরবতর্ী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। বিকাল ৩ টায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পল্টন ময়দানের স্বতঃস্ফূর্ত জনসভায় যোগদান করি। সেখানে আমি আমার বক্তৃতায় বলি, "আর ৬ দফা ও ১১ দফা নয়। এবার বাংলার মানুষ ১ দফার সংগ্রাম শুরু করবে। আর এই ১ দফা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আজ আমরাও শপথ নিলাম_ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।" শত-সহস্র মিছিলে জনসমুদ্রে পরিণত হলো পল্টন ময়দান। প্রতিবাদ সভায় আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশ মতো আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ডেকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন। নেতার নির্দেশ পেয়ে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সর্বজনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আসম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক বৈঠকে বিকেলে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে 'স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করে। একমাত্র ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দই সব ধরনের ঝুঁকির মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নেয়।
২ মার্চ ১৯৭১
এদিন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় এবং তাঁর নির্দেশে সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এ পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব প্রদান করেন ছাত্রলীগ সভাপতি জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক জনাব শাজাহান সিরাজ, ডাকসু সহ-সভাপতি জনাব আসম আব্দুর রব এবং সাধারণ সম্পাদক জনাব আব্দুল কুদ্দুস মাখন। পরে এ পতাকা নিয়ে আন্দোলিত রাজপথ মুখর হয়ে ওঠে শেস্নাগানে শেস্নাগানে, 'জাগো জাগো, বাঙালি জাগো'; 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা'; 'স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব'; 'বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে'; 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি'; 'তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ'; 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, সোনার বাংলা মুক্ত করো'; 'পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা'; 'পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা'; 'ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'; 'স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ছাত্র নেতৃবৃন্দের বিশাল একটি মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সমবেত হয়। এদিন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিতে ২ জন নাগরিক প্রাণ হারানোর সংবাদে বঙ্গবন্ধু তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি প্রদান করেন এবং ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে অর্ধদিবস হরতালের কর্মসূচী ঘোষণা করেন।
সামরিক কর্তৃপক্ষ সান্ধ্য আইন জারি করলে জনতা তা অমান্য করে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর কুশপুত্তলিকা দাহ করে রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং সেনাবাহিনী বিনা উস্কানিতে গুলিবর্ষণ করলে নগরীর বিভিন্ন স্থানে মিছিল সহিংস হয়ে ওঠে।
৩ মার্চ ১৯৭১
এদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি জনাব নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জনাব শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। ইশতেহারে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়। জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচিত করা হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি" গানটি। লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ অনুষ্ঠানটি ছিল আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এক উলেস্নখযোগ্য দিন। এদিনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে তাঁর বক্তৃতায় অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবী করেন। আর জনতার উদ্দেশে অফিস-আদালত বন্ধ রেখে, খাজনা-ট্যাক্স না দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। এদিনের ঐতিহাসিক সভায় আমার বক্তৃতায়ও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের প্রতিধ্বনি করে কর্মসূচী সফল করতে দেশবাসির প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই। এদিন বাংলার মাটি শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়। চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলীতে ৭১ জন নিহত হয়। সারাদেশ অগি্নগর্ভ হয়ে ওঠে।
৪ মার্চ ১৯৭১
এদিনও বঙ্গবন্ধু ঘোষিত পূর্ব কর্মসূচী অনুযায়ী সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ঢাকায় সাময়িকভাবে কারফিউ তুলে নেওয়া হলেও চট্টগ্রাম, খুলনা ও রংপুরে তা বলবৎ থাকে। খুলনায় হরতাল পালনকালে নিরস্ত্র জনতার উপর সেনাবাহিনীর বিক্ষিপ্ত গুলীবর্ষণে ৬ জন নিহত হয় ও ২২ জন আহত হয়। চট্টগ্রামে এদিনও সেনাবাহিনীর গুলীবর্ষণে গতকাল আর আজ মিলে সর্বমোট ১২০ জন নিহত ও ৩৩৫ জন আহত হয়। সারাদেশে আহতদের সুচিকিৎসার্থে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শত সহস্র মানুষ লাইন দিয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান করে। ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও নিহতদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরকম উত্তাল পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে আওয়ামী লীগের এক মুলতবী সভায় ভবিষ্যৎ কর্মসূচী ব্যাখ্যা করে সংগ্রামের নুতন দিক-নির্দেশনায় বলেন, "আজ আওয়ামী লীগ নয়, গোটা বাঙালি জাতিই অগি্ন-পরীক্ষার সম্মুখীন। আমাদের সামনে আজ দু'টো পথ খোলা আছে। একটি সর্বাত্মক ত্যাগ স্বীকারের জন্য নিজেদের মনোবল অটুট রেখে অবিচলভাবে পূর্ণ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া অথবা ভুট্টো-ইয়াহিয়ার কথামত সব কিছু মেনে নেওয়া।" নিজের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "আপনারা জানেন, আমি সারা জীবন ক্ষমতার মসনদ তুচ্ছ জ্ঞান করে দেশ ও জাতির কাছে আমার জীবন মর্টগেজ রেখেছি। বাংলার মানুষ গুলী খেয়ে বন্দুকের নলের কাছে বুক পেতে দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফাঁসি কাষ্ঠ থেকে আমাকে মুক্ত করে এনেছে। আমার ৬ দফা কর্মসূচীর প্রতি ম্যান্ডেট দিয়েছে। এখন শহীদের পবিত্র আত্মত্যাগের প্রতি অশ্রদ্ধা জানিয়ে পাকিস্তানীদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে অবমাননাকর শর্তে কী করে ক্ষমতায় যাই?" অতঃপর বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের মধ্যে সারাদেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাঠামো তৈরির নির্দেশ প্রদান করেন। এদিনের উলেস্নখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের নুতন নামকরণ করেন 'ঢাকা বেতার কেন্দ্র'। পাকিস্তান টেলিভিশনের নাম পাল্টে 'ঢাকা টেলিভিশন' নাম দিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতে থাকে। কার্যত সারা বাংলা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে।
৫ মার্চ ১৯৭১
এদিন হরতাল কর্মসূচী পালনকালে টঙ্গীতে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে ৬ জন নিহত ও ৩৫ জন আহত হন। খুলনা ও রাজশাহীতেও যথাক্রমে ২ জন ও ১ জন নিহত হন। টঙ্গীতে ২০ হাজারেরও বেশী শ্রমিক স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিক্ষোভ মিছিল বের করলে সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলীবর্ষণ করে। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিকালে আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম থেকে এক বিশাল লাঠি মিছিল বের হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে ব্যাংকিং লেনদেনের ওপর নুতন নির্দেশ দেওয়া হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ এদিন চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেট ও দেশের অন্যান্য স্থানে সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের চিত্র তুলে ধরেন। যে কোন জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আওয়ামী লীগ একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে। এদিন তাহরিক-ই-ইশতিকলাল পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল (অবঃ) আসগর খান পাকিস্তানের সংহতি বিপন্ন উলেস্নখ করে অবিলম্বে শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান।
৬ মার্চ ১৯৭১
সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বিগত কয়েকদিনে সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ সকলেই স্ব-স্ব অবস্থান থেকে প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হতে থাকেন। এ ক'দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলার জনগণকে দায়ী করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এদিন বেতারে ভাষণ দেন। ৫ মার্চ ইয়াহিয়া এবং জনাব ভুট্টো ৫ ঘন্টা গোপনে বৈঠক করে যে খসড়া তৈরি করেছিলেন বক্তৃতায় সেটিই প্রতিফলিত হয়। এদিন ঢাকাসহ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙ্গে ৩৪১ জন কারাবন্দী পলায়নকালে পুলিশের গুলিতে ৭ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও 'খ' অঞ্চলের সামরিক শাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে সরিয়ে তদস্থলে 'বেলুচিস্তানের কসাই'খ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে উভয় পদে নিযুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এয়ার মাশর্াল আসগর খান বঙ্গবন্ধুর সাথে দ্বিতীয় দফা বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, "পরিস্থিতি রক্ষায় আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। বাকি বিষয় আগামীকাল শেখ মুজিবের বক্তৃতায় জানতে পারবেন।" কার্যত, সারাদেশের মানুষ এদিন থেকে অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে পরবতর্ী দিকনির্দেশনা জানার। এদিন আমি এক বিবৃতিতে ৭ মার্চের ভাষণ রেসকোর্স থেকে সরাসরি প্রচারের জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানাই।
বাংলাদেশ ৭ মার্চ ১৯৭১
১৯৭১-এর সাতই মার্চের বসন্তে জাতির হূদয় জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত হয়েছিল, উত্তাল হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ডাকে। অগি্নঝরা উত্তাল মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের ঊর্মিমুখর দিনগুলো আজও চোখে ভাসে। বাঙালি জাতি
ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একই সঙ্গে স্বাধীনতার মন্ত্রে এক সুতোয় বাঁধা পড়ার দিন সাতই মার্চ। সেদিন তাঁর অঙ্গুলি হেলনে কার্যত পাকিস্তানের পতন ঘটেছিল। তাঁর বজ্রকণ্ঠে সেদিন ফুঁসে উঠেছিল পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। যে বজ্রকণ্ঠের উচ্চ নিনাদে নগর-বন্দর থেকে গ্রামের মেঠো পথে মানুষের হূদয় জাতীয় মুক্তির নেশায় জেগে উঠেছিল। রেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) মঞ্চ ঘিরে সেদিন সকাল থেকেই বিক্ষুব্ধ বাংলার সংগ্রামী জনতা এক স্রোতে এসে মিশেছিল। সে কি উন্মাদনা! সে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ! কী উত্তেজনাময় দিনই না ছিল জাতির জীবনে। এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঙালির প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার স্বপ্ন সামনে রেখে কী বলবেন তাঁর জনগণকে? এই প্রশ্নটিই ছিল সবার কৌতূহলী মনে। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও আদর্শ সামনে নিয়ে যারা সংগ্রাম করে- শত অত্যাচার-নির্যাতনের দুঃসহ যন্ত্রণা তাদের গতিপথকে রোধ করতে পারে না। তাই কারাগারের অন্ধকার নিঃসঙ্গ মুহূর্তেও নয়, কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী শাসকদের কাছে মাথানত করেননি। কোনো কিছুই তাঁকে তাঁর অঙ্গীকার আর লক্ষ্য থেকে সরাতে পারেনি। ঢাকা শহরে শেস্নাগান আর শেস্নাগান। সংগ্রামী বাংলা সেদিন ছিল অগি্নগর্ভ, দুর্বিনীত। কারও চাপিয়ে দেয়া অন্যায় প্রভুত্ব মেনে নেয়ার জন্য, কারও কলোনী বা করদ রাজ্য হিসাবে থাকার জন্য বাংলার মানুষের জন্ম হয়নি। বাংলার অপরাজেয় গণশক্তি সেদিন সার্বিক জাতীয় মুক্তি অর্জনের ইস্পাত-কঠিন শপথের দীপ্তিতে ভাস্বর প্রিয় নেতাকে যেন দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ প্রদান করে উচ্চকণ্ঠ হয়েছিল এই শেস্নাগানে, 'জাগো জাগো, বাঙালি জাগো'; 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা'; 'তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব'; 'বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে'; 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি'; 'তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ'; 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, সোনার বাংলা মুক্ত করো'; 'পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা'; 'পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা'; 'ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'; 'স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'। ইয়াহিয়ার ঘোষণায় জনতার রুদ্র রোষে ঢাকা হয়ে পড়ে বিক্ষুব্ধ মিছিলের নগরী। আজ সাতই মার্চের সেই দিনটির কথা ভাবলে বিস্ময় জাগে! বঙ্গবন্ধু সেদিন নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বীরের জাতিতে পরিণত করেন। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে ছুটে আসা ১০ লাখেরও বেশি জনতা ছিল যেন প্রতিটি ঘরে ঘরে স্বাধীনতার বার্তা পেঁৗছে দেয়ার একেকজন দূত। স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার উন্মাদনা ছড়িয়েছিলেন। সেই উন্মাদনা গোটা জাতির রক্তে ছড়িয়েছিল। নেতা জানতেন তার মানুষের ভাষা। জনগণ বুঝতো নেতার ইশারা। নেতার কণ্ঠের মাধুর্য তাদের জানা ছিল। তাই জাতি সেদিনই নেতার ডাক পেয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আর সেদিনের রেসকোর্স ময়দান যেন আবহমান বাংলার বাসন্তী সূর্য আর উদার আকাশকে সাক্ষী রেখে নির্ভীক নেতা এবং বীর বাঙালির কণ্ঠে একই সুরে ধ্বনিত হয়ে ওঠে যুগ-যুগান্তর, দেশ-দেশান্তরের সকল মুক্তিপিপাসু সভ্য জাতির অমোঘ মন্ত্র:"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" দিগন্ত কাঁপিয়ে নিযুত কণ্ঠে ধ্বনি ওঠে 'জয় বাংলা'। সাতই মার্চ তাই বাংলাদেশের সার্বিক মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে দুর্গম প্রস্তর পথের প্রান্তে অতুলনীয় স্মৃতিফলক। সেদিন ছিল রবিবার। সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনটি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সরগরম। পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী বেলা ২টায় সভা শুরু হওয়ার কথা। জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দসহ আমাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে বঙ্গবন্ধু জনসভার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। রাজ্জাক ভাই, সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, মনি ভাই, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবদুর রউফ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, সিরাজুল আলম খানসহ আমরা একটি গাড়িতে রওয়ানা করি।নিরাপত্তার জন্য রাজ্জাক ভাই ও গাজী গোলাম মোস্তফা ড্রাইভারকে ৩২ নম্বর সড়কের পশ্চিম দিক দিয়ে যেতে বলেন। রেসকোর্স ময়দানে সেদিন মুক্তিকামী মানুষের ঢল নেমেছিল। আকারের বিশালত্ব, অভিনবত্বের অনন্য মহিমা আর সংগ্রামী চেতনার অতুল বৈভবে এই গণমহাসমুদ্র ছিল নজিরবিহীন। চারদিকে লক্ষ-মানুষের গগনবিদারী কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে 'জয় বাংলা' শেস্নাগান। কার্যত ১৯৬৯ থেকেই 'জয় বাংলা' শেস্নাগানটি ছিল বাঙালির রণধ্বনি। বীর বাঙালির হাতে বাঁশের লাঠি এবং কণ্ঠে জয় বাংলা শেস্নাগান যেন প্রলয় রাত্রির বিদ্রোহী বঙ্গোপসাগরের সঘন গর্জন। সাতই মার্চ সকাল থেকেই সারাদেশের জনস্রোত এসে মিলিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দানে। রেসকোর্স ময়দান যেন বিক্ষুব্ধ বাংলার চিত্র। সেদিন প্রিয় নেতা হূদয় আর চেতনা থেকে যে ডাক দিয়েছেন তা সমগ্র জাতি সানন্দে গ্রহণ করেছে। সকাল থেকেই কী এক উত্তেজনায় টালমাটাল দেশ! কী বলবেন আজ বঙ্গবন্ধু? এই প্রশ্ন নিয়ে লাখ লাখ জনতার মিছিল ছুটে আসে রেসকোর্স ময়দানের দিকে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা সভামঞ্চে এলাম ৩টা ১৫ মিনিটে। দীর্ঘ ২৩ বছরের শত সংগ্রাম শেষে দৃঢ়তার সঙ্গে আপোষহীন অবয়ব নিয়ে নেতা এসে দাঁড়ালেন জনতার মঞ্চে। জনতার হূদয়ে যেন আকাশ স্পর্শ করার আনন্দ দোলা দিয়ে গেল। কিন্তু ঊর্মিমুখর জনতার মধ্যে অধৈর্যের কোনো লক্ষণ দেখিনি। নির্দিষ্ট সময়ের বহু আগেই অর্থাৎ সকাল থেকে জনতার স্রোত এসে মিলিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দানে। জনস্রোতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় সভাস্থল। মানুষ গাছের উপরে উঠে বসে নেতার বক্তৃতা শোনার জন্য। সেদিনের সেই গণ-মহাসমুদ্রে আগত মানুষের বয়স, পেশা, সামাজিক মর্যাদা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও শ্রেণীগত অবস্থানের যতই ফারাক থাকুক না কেন, সে জনতার মধ্যে আশ্চর্য যে সুশৃঙ্খল ঐকতান ছিল তা হচ্ছে, হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠের শেস্নাগান আর অন্তরের অন্তরতম কোণে লালিত জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির পর কালো মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন, বাংলার বীর জনতা বজ্রনির্ঘোষে তুমুল করতালি ও শেস্নাগানের মধ্যে তাঁকে বীরোচিত অভিনন্দন জ্ঞাপন করে। তাঁর চোখে-মুখে তখন সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের সুযোগ্য সর্বাধিনায়কের দুর্লভ তেজোদৃপ্ত কাঠিন্য আর সংগ্রামী শপথের দীপ্তির মিথস্ক্রিয়ায় জ্যোতির্ময় অভিব্যক্তি খেলা করতে থাকে। আমরা হিমালয়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে শুনে যাচ্ছি তাঁর সেই দুনিয়া কাঁপানো ভাষণ। যে ভাষণকে বিশেষজ্ঞগণ তুলনা করেন আব্রাহাম লিংকনের 'গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস'-এর সঙ্গে। অমন সাজানো-গোছানো নির্ভুল, ছন্দোবদ্ধ, প্রাঞ্জল, উদ্দীপনাময় ভাষণটি তিনি রাখলেন। কী আস্থা তাঁর প্রিয় স্বদেশের মানুষের প্রতি, প্রধানমন্ত্রিত্ব এমনকি জীবনের চেয়েও কত বেশী প্রিয় তাঁর মাতৃভূমির স্বাধীনতা তাই তিনি শোনালেন। এতটাই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ছিলেন যে, ভাষণে তিনি একদিকে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, অন্যদিকে শাসকের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করার পাতানো ফাঁদেও পা দিলেন না। 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' যেমন বললেন; তেমনি চার শর্তের জালে ফেললেন শাসকের ষড়যন্ত্রের দাবার ঘুঁটি। বললেন- সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে; সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে; নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে; গণহত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। রক্তের দাগ না মোছা পর্যন্ত অধিবেশনে যোগ না দেয়ার কথাটিও বললেন। ক্যান্টনমেন্টে তখন গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলার প্রস্তুতি। কিন্তু নেতার বিচক্ষণতায় রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হলো। সাতই মার্চের ভাষণ নয়, যেন মহানায়কের বাঁশিতে উঠে আসা স্বাধীনতার সুর। সেই সুরে বীর বাঙালির মনই শুধু নয়, রক্তেও সশস্ত্র স্বাধীনতার নেশা ধরিয়ে দিলো। ভাষণটি বঙ্গবন্ধু নিজ সিদ্ধান্তেই দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের সহযাত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জানিয়েছিলেন, ৬ মার্চ সারা রাত বঙ্গবন্ধু বিচলিত-অস্থির ছিলেন, তিনি কী বলবেন তাঁর জনগণকে তা নিয়ে। বেগম মুজিব বলেছিলেন, 'তুমি যা বিশ্বাস করো তাই বলবে।' সেই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো শিহরিত হই। এখনো কানে বাজে নেতা বলছেন, 'আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবে। আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, বাংলার মানুষের অধিকার চাই।' সেদিন রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের মহাসমাবেশ ঘটেছিল সার্বিক জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবতর্ী কর্মসূচি সম্পর্কে পথনির্দেশ লাভের জন্য। আমরা যারা সেদিনের সেই জনসভার সংগঠক ছিলাম, যারা আমরা মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পদতলের পাশে বসে ময়দানে উপস্থিত জনতার চোখে-মুখে প্রতিবাদের-প্রতিরোধের যে অগি্নশিখা দেখেছি তা আজও স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে আছে। কিন্তু তারা ছিল শান্ত-সংযত- নেতার পরবতর্ী নির্দেশ শোনার প্রতীক্ষায় তারা ছিল ব্যাগ্র-ব্যাকুল এবং মন্ত্রমুগ্ধ। কী উত্তেজনাময়, আবেগঘন মুহূর্ত ছিল সেদিন। বঙ্গবন্ধু যখন বক্তৃতা শুরু করলেন জনসমুদ্র যেন প্রশান্ত এক গাম্ভীর্য নিয়ে পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে গেল। এতো কোলাহল, এতো মুহুমর্ুহু গর্জন নিমেষেই উধাও। আবার পরক্ষণেই সেই জনতাই সংগ্রামী শপথ ঘোষণায় উদ্বেলিত হয়েছে মহাপ্রলয়ের উত্তাল জলধির মতো, যেন 'জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার'। তাইতো জোয়ার-ভাটার দেশ এই বাংলাদেশ, আশ্চর্য বাঙালির মন ও মানস। সাতই মার্চের রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে সম্বোধন করেছেন, 'ভাইয়েরা আমার' বলে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নির্যাতিত-মুমূর্ষু-বিক্ষুব্ধ চেতনাকে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে নির্দেশ দিয়েছেন, "ঃপ্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।" ১১০৮টি শব্দ সম্বলিত প্রায় ১৯ মিনিটের এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন বাঙালি জাতি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। বঙ্গবন্ধু যখন জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের রূপরেখা আর নিজের চরম ত্যাগের কথা ঘোষণা করছিলেন তখন তাঁর কণ্ঠ কাঁপেনি, থামেনি- জনশক্তির বলে বলীয়ান গণনায়কের কণ্ঠ বজ্রের হুঙ্কারের মতোই গর্জে উঠেছিল। ইতিহাসের আশীর্বাদস্বরূপ নেতা আর জনতার শিরোপরি যেন বসন্তের আকাশ হতে বিদায়ী সূর্যের আলোকরশ্মি ঝরে পড়ছিল। ঐতিহাসিক সেই দুর্লভ প্রাঙ্গণটিতে আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল নেতার পদপ্রান্তে বসে সাড়ে সাত কোটি বঞ্চিত-অবহেলিত-নিরন্ন নর-নারীর অবিসংবাদিত নেতার দুর্জয় সঙ্কল্পবদ্ধ অপরূপ রূপ প্রত্যক্ষ করার। সাতই মার্চ অনন্য-অবিস্মরণীয়।
১৯৭১-এর সাতই মার্চের বসন্তে জাতির হূদয় জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত হয়েছিল, উত্তাল হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ডাকে। অগি্নঝরা উত্তাল মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের ঊর্মিমুখর দিনগুলো আজও চোখে ভাসে। বাঙালি জাতি
ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একই সঙ্গে স্বাধীনতার মন্ত্রে এক সুতোয় বাঁধা পড়ার দিন সাতই মার্চ। সেদিন তাঁর অঙ্গুলি হেলনে কার্যত পাকিস্তানের পতন ঘটেছিল। তাঁর বজ্রকণ্ঠে সেদিন ফুঁসে উঠেছিল পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। যে বজ্রকণ্ঠের উচ্চ নিনাদে নগর-বন্দর থেকে গ্রামের মেঠো পথে মানুষের হূদয় জাতীয় মুক্তির নেশায় জেগে উঠেছিল। রেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) মঞ্চ ঘিরে সেদিন সকাল থেকেই বিক্ষুব্ধ বাংলার সংগ্রামী জনতা এক স্রোতে এসে মিশেছিল। সে কি উন্মাদনা! সে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ! কী উত্তেজনাময় দিনই না ছিল জাতির জীবনে। এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঙালির প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার স্বপ্ন সামনে রেখে কী বলবেন তাঁর জনগণকে? এই প্রশ্নটিই ছিল সবার কৌতূহলী মনে। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও আদর্শ সামনে নিয়ে যারা সংগ্রাম করে- শত অত্যাচার-নির্যাতনের দুঃসহ যন্ত্রণা তাদের গতিপথকে রোধ করতে পারে না। তাই কারাগারের অন্ধকার নিঃসঙ্গ মুহূর্তেও নয়, কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী শাসকদের কাছে মাথানত করেননি। কোনো কিছুই তাঁকে তাঁর অঙ্গীকার আর লক্ষ্য থেকে সরাতে পারেনি। ঢাকা শহরে শেস্নাগান আর শেস্নাগান। সংগ্রামী বাংলা সেদিন ছিল অগি্নগর্ভ, দুর্বিনীত। কারও চাপিয়ে দেয়া অন্যায় প্রভুত্ব মেনে নেয়ার জন্য, কারও কলোনী বা করদ রাজ্য হিসাবে থাকার জন্য বাংলার মানুষের জন্ম হয়নি। বাংলার অপরাজেয় গণশক্তি সেদিন সার্বিক জাতীয় মুক্তি অর্জনের ইস্পাত-কঠিন শপথের দীপ্তিতে ভাস্বর প্রিয় নেতাকে যেন দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ প্রদান করে উচ্চকণ্ঠ হয়েছিল এই শেস্নাগানে, 'জাগো জাগো, বাঙালি জাগো'; 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা'; 'তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব'; 'বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে'; 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি'; 'তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ'; 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, সোনার বাংলা মুক্ত করো'; 'পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা'; 'পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা'; 'ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'; 'স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'। ইয়াহিয়ার ঘোষণায় জনতার রুদ্র রোষে ঢাকা হয়ে পড়ে বিক্ষুব্ধ মিছিলের নগরী। আজ সাতই মার্চের সেই দিনটির কথা ভাবলে বিস্ময় জাগে! বঙ্গবন্ধু সেদিন নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বীরের জাতিতে পরিণত করেন। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে ছুটে আসা ১০ লাখেরও বেশি জনতা ছিল যেন প্রতিটি ঘরে ঘরে স্বাধীনতার বার্তা পেঁৗছে দেয়ার একেকজন দূত। স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার উন্মাদনা ছড়িয়েছিলেন। সেই উন্মাদনা গোটা জাতির রক্তে ছড়িয়েছিল। নেতা জানতেন তার মানুষের ভাষা। জনগণ বুঝতো নেতার ইশারা। নেতার কণ্ঠের মাধুর্য তাদের জানা ছিল। তাই জাতি সেদিনই নেতার ডাক পেয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আর সেদিনের রেসকোর্স ময়দান যেন আবহমান বাংলার বাসন্তী সূর্য আর উদার আকাশকে সাক্ষী রেখে নির্ভীক নেতা এবং বীর বাঙালির কণ্ঠে একই সুরে ধ্বনিত হয়ে ওঠে যুগ-যুগান্তর, দেশ-দেশান্তরের সকল মুক্তিপিপাসু সভ্য জাতির অমোঘ মন্ত্র:"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" দিগন্ত কাঁপিয়ে নিযুত কণ্ঠে ধ্বনি ওঠে 'জয় বাংলা'। সাতই মার্চ তাই বাংলাদেশের সার্বিক মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে দুর্গম প্রস্তর পথের প্রান্তে অতুলনীয় স্মৃতিফলক। সেদিন ছিল রবিবার। সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনটি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সরগরম। পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী বেলা ২টায় সভা শুরু হওয়ার কথা। জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দসহ আমাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে বঙ্গবন্ধু জনসভার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। রাজ্জাক ভাই, সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, মনি ভাই, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবদুর রউফ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, সিরাজুল আলম খানসহ আমরা একটি গাড়িতে রওয়ানা করি।নিরাপত্তার জন্য রাজ্জাক ভাই ও গাজী গোলাম মোস্তফা ড্রাইভারকে ৩২ নম্বর সড়কের পশ্চিম দিক দিয়ে যেতে বলেন। রেসকোর্স ময়দানে সেদিন মুক্তিকামী মানুষের ঢল নেমেছিল। আকারের বিশালত্ব, অভিনবত্বের অনন্য মহিমা আর সংগ্রামী চেতনার অতুল বৈভবে এই গণমহাসমুদ্র ছিল নজিরবিহীন। চারদিকে লক্ষ-মানুষের গগনবিদারী কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে 'জয় বাংলা' শেস্নাগান। কার্যত ১৯৬৯ থেকেই 'জয় বাংলা' শেস্নাগানটি ছিল বাঙালির রণধ্বনি। বীর বাঙালির হাতে বাঁশের লাঠি এবং কণ্ঠে জয় বাংলা শেস্নাগান যেন প্রলয় রাত্রির বিদ্রোহী বঙ্গোপসাগরের সঘন গর্জন। সাতই মার্চ সকাল থেকেই সারাদেশের জনস্রোত এসে মিলিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দানে। রেসকোর্স ময়দান যেন বিক্ষুব্ধ বাংলার চিত্র। সেদিন প্রিয় নেতা হূদয় আর চেতনা থেকে যে ডাক দিয়েছেন তা সমগ্র জাতি সানন্দে গ্রহণ করেছে। সকাল থেকেই কী এক উত্তেজনায় টালমাটাল দেশ! কী বলবেন আজ বঙ্গবন্ধু? এই প্রশ্ন নিয়ে লাখ লাখ জনতার মিছিল ছুটে আসে রেসকোর্স ময়দানের দিকে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা সভামঞ্চে এলাম ৩টা ১৫ মিনিটে। দীর্ঘ ২৩ বছরের শত সংগ্রাম শেষে দৃঢ়তার সঙ্গে আপোষহীন অবয়ব নিয়ে নেতা এসে দাঁড়ালেন জনতার মঞ্চে। জনতার হূদয়ে যেন আকাশ স্পর্শ করার আনন্দ দোলা দিয়ে গেল। কিন্তু ঊর্মিমুখর জনতার মধ্যে অধৈর্যের কোনো লক্ষণ দেখিনি। নির্দিষ্ট সময়ের বহু আগেই অর্থাৎ সকাল থেকে জনতার স্রোত এসে মিলিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দানে। জনস্রোতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় সভাস্থল। মানুষ গাছের উপরে উঠে বসে নেতার বক্তৃতা শোনার জন্য। সেদিনের সেই গণ-মহাসমুদ্রে আগত মানুষের বয়স, পেশা, সামাজিক মর্যাদা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও শ্রেণীগত অবস্থানের যতই ফারাক থাকুক না কেন, সে জনতার মধ্যে আশ্চর্য যে সুশৃঙ্খল ঐকতান ছিল তা হচ্ছে, হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠের শেস্নাগান আর অন্তরের অন্তরতম কোণে লালিত জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির পর কালো মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন, বাংলার বীর জনতা বজ্রনির্ঘোষে তুমুল করতালি ও শেস্নাগানের মধ্যে তাঁকে বীরোচিত অভিনন্দন জ্ঞাপন করে। তাঁর চোখে-মুখে তখন সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের সুযোগ্য সর্বাধিনায়কের দুর্লভ তেজোদৃপ্ত কাঠিন্য আর সংগ্রামী শপথের দীপ্তির মিথস্ক্রিয়ায় জ্যোতির্ময় অভিব্যক্তি খেলা করতে থাকে। আমরা হিমালয়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে শুনে যাচ্ছি তাঁর সেই দুনিয়া কাঁপানো ভাষণ। যে ভাষণকে বিশেষজ্ঞগণ তুলনা করেন আব্রাহাম লিংকনের 'গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস'-এর সঙ্গে। অমন সাজানো-গোছানো নির্ভুল, ছন্দোবদ্ধ, প্রাঞ্জল, উদ্দীপনাময় ভাষণটি তিনি রাখলেন। কী আস্থা তাঁর প্রিয় স্বদেশের মানুষের প্রতি, প্রধানমন্ত্রিত্ব এমনকি জীবনের চেয়েও কত বেশী প্রিয় তাঁর মাতৃভূমির স্বাধীনতা তাই তিনি শোনালেন। এতটাই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ছিলেন যে, ভাষণে তিনি একদিকে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, অন্যদিকে শাসকের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করার পাতানো ফাঁদেও পা দিলেন না। 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' যেমন বললেন; তেমনি চার শর্তের জালে ফেললেন শাসকের ষড়যন্ত্রের দাবার ঘুঁটি। বললেন- সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে; সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে; নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে; গণহত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। রক্তের দাগ না মোছা পর্যন্ত অধিবেশনে যোগ না দেয়ার কথাটিও বললেন। ক্যান্টনমেন্টে তখন গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলার প্রস্তুতি। কিন্তু নেতার বিচক্ষণতায় রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হলো। সাতই মার্চের ভাষণ নয়, যেন মহানায়কের বাঁশিতে উঠে আসা স্বাধীনতার সুর। সেই সুরে বীর বাঙালির মনই শুধু নয়, রক্তেও সশস্ত্র স্বাধীনতার নেশা ধরিয়ে দিলো। ভাষণটি বঙ্গবন্ধু নিজ সিদ্ধান্তেই দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের সহযাত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জানিয়েছিলেন, ৬ মার্চ সারা রাত বঙ্গবন্ধু বিচলিত-অস্থির ছিলেন, তিনি কী বলবেন তাঁর জনগণকে তা নিয়ে। বেগম মুজিব বলেছিলেন, 'তুমি যা বিশ্বাস করো তাই বলবে।' সেই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো শিহরিত হই। এখনো কানে বাজে নেতা বলছেন, 'আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবে। আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, বাংলার মানুষের অধিকার চাই।' সেদিন রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের মহাসমাবেশ ঘটেছিল সার্বিক জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবতর্ী কর্মসূচি সম্পর্কে পথনির্দেশ লাভের জন্য। আমরা যারা সেদিনের সেই জনসভার সংগঠক ছিলাম, যারা আমরা মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পদতলের পাশে বসে ময়দানে উপস্থিত জনতার চোখে-মুখে প্রতিবাদের-প্রতিরোধের যে অগি্নশিখা দেখেছি তা আজও স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে আছে। কিন্তু তারা ছিল শান্ত-সংযত- নেতার পরবতর্ী নির্দেশ শোনার প্রতীক্ষায় তারা ছিল ব্যাগ্র-ব্যাকুল এবং মন্ত্রমুগ্ধ। কী উত্তেজনাময়, আবেগঘন মুহূর্ত ছিল সেদিন। বঙ্গবন্ধু যখন বক্তৃতা শুরু করলেন জনসমুদ্র যেন প্রশান্ত এক গাম্ভীর্য নিয়ে পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে গেল। এতো কোলাহল, এতো মুহুমর্ুহু গর্জন নিমেষেই উধাও। আবার পরক্ষণেই সেই জনতাই সংগ্রামী শপথ ঘোষণায় উদ্বেলিত হয়েছে মহাপ্রলয়ের উত্তাল জলধির মতো, যেন 'জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার'। তাইতো জোয়ার-ভাটার দেশ এই বাংলাদেশ, আশ্চর্য বাঙালির মন ও মানস। সাতই মার্চের রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে সম্বোধন করেছেন, 'ভাইয়েরা আমার' বলে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নির্যাতিত-মুমূর্ষু-বিক্ষুব্ধ চেতনাকে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে নির্দেশ দিয়েছেন, "ঃপ্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।" ১১০৮টি শব্দ সম্বলিত প্রায় ১৯ মিনিটের এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন বাঙালি জাতি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। বঙ্গবন্ধু যখন জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের রূপরেখা আর নিজের চরম ত্যাগের কথা ঘোষণা করছিলেন তখন তাঁর কণ্ঠ কাঁপেনি, থামেনি- জনশক্তির বলে বলীয়ান গণনায়কের কণ্ঠ বজ্রের হুঙ্কারের মতোই গর্জে উঠেছিল। ইতিহাসের আশীর্বাদস্বরূপ নেতা আর জনতার শিরোপরি যেন বসন্তের আকাশ হতে বিদায়ী সূর্যের আলোকরশ্মি ঝরে পড়ছিল। ঐতিহাসিক সেই দুর্লভ প্রাঙ্গণটিতে আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল নেতার পদপ্রান্তে বসে সাড়ে সাত কোটি বঞ্চিত-অবহেলিত-নিরন্ন নর-নারীর অবিসংবাদিত নেতার দুর্জয় সঙ্কল্পবদ্ধ অপরূপ রূপ প্রত্যক্ষ করার। সাতই মার্চ অনন্য-অবিস্মরণীয়।
[লেখক: আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য, সভাপতি, শিল্প মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি]
Subscribe to:
Posts (Atom)
Photographs, Audio, Video and Text on Bangabandhu ***Please use Vrinda Font if there is a problem to read Bangla *** Click o...