Saturday 28 August 2010

রক্তঝরা মার্চ : ফিরে দেখা---- তোফায়েল আহমেদ


মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ভাষণের পর ৮ মার্চ থেকে দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশ পরিচালিত হতে থাকেএই প্রথমবারের মতো বাংলার মানুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে চলতে শুরু করলোবঙ্গবন্ধু তাই বাংলার মানুষকে গর্ব করে বলছেন, 'আজ ভাবতে আমার কত ভালো লাগে, আজ একটি সুন্দর ধর্মঘট পালিত হচ্ছে আজ বাংলার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছেআজ এই প্রথম বাঙালিরা প্রথমবার নিজেদের শাসনভার নিজেদের হাতে গ্রহণ করেছে' আমরা যারা তরুণ, তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন - গ্রামে গ্রামে যাও, যেটা তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল- আমরা সেই নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করেছিতিনি আরো বলেছিলেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করোআমরা তাঁর নির্দেশে প্রত্যেক গ্রামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদও গড়ে তুলেছিএবং বিভিন্ন জায়গায় আমরা অস্ত্রের ট্রেনিং নিতে শুরু করলামঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি গ্রামে মানুষ হাতিয়ার তুলে নিয়েছে অর্থা মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ একটি নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে একটি সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেছেআর সেই কার্যক্রম ৮ মার্চ থেকেই শুরু হয়এভাবেই ৮, ৯ ও ১০ মার্চ থেকে আমরা ২৫ মার্চ পর্যন্ত আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছি এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা আমাদেরকে সংগঠিত করেছি

আমাদের মধ্যে চারজন- শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু যুব সমাজ ও ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার জন্য আমরা সেই দায়িত্ব পালন করেছিএছাড়াও বঙ্গবন্ধু যারা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা তাদেরকে সংগঠিত করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল ওসমানীকে কাজের সঙ্গে আমাকে যুক্ত হওয়ার বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেনএভাবে আমরা একেকজন একেক দায়িত্ব গ্রহণ করলাম

আমাদের যে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ- নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আসম আব্দুর রব এবং আব্দুল কুদ্দুস মাখন সারা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করতে শুরু করলোআজকে যখন ভাবি আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি হানাদারমুক্ত হয়েছে, স্বাধীন হয়েছে-আমার মনে পড়ে '৬৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টনের জনসভার কথাসেদিন আমরা বলেছিলাম, 'শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করবো, শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মাগো তোমায় মুক্ত করবো' ভাবতে কত ভালো লাগে '৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়েছেনআর ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে নিরস্ত্র জাতি সশস্ত্র জাতি হয়ে উঠেছেহাতিয়ার দিয়ে যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর বাংলা মা-কে আমরা মুক্ত করেছিএই মুক্তির আন্দোলনের প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিলকিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরদিন থেকে সমস্ত বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, এক সুতায় নিজেদের গেঁথেছে

সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ সকলেই স্ব-স্ব অবস্থান থেকে প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হতে থাকেনএ ক'দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলার জনগণকে দায়ী করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এদিন বেতারে ভাষণ দেন৫ মার্চ ইয়াহিয়া এবং জনাব ভুট্টো ৫ ঘন্টা গোপনে বৈঠক করে যে খসড়া তৈরি করেছিলেন বক্তৃতায় সেটিই প্রতিফলিত  হয়এদিন ঢাকাসহ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়

পূর্ব প্রেক্ষাপট

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় এসে ১২ ও ১৩ জানুয়ারি এই দুই দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দু'দফা আলোচনায় মিলিত হনআলোচনার ফলাফল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান, "আলোচনা সন্তোষজনক হয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট খুব শীঘ্রই ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে সম্মত হয়েছেন।" অপরদিকে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তেজগাঁও বিমানবন্দরে জেনারেল ইয়াহিয়া সাংবাদিকদের বলেন, "দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তাঁর সঙ্গে আলোচনা সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন তা পুরোপুরি সঠিক।" ঢাকা থেকে ফিরে ইয়াহিয়া খান লারকানায় ভুট্টোর বাসভবনে যান এবং সেখানে জেনারেলদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হনমূলত লারকানা বৈঠকেই নির্বাচনী ফলাফল বানচালের নীল নকশা প্রণীত হয়অতঃপর জানুয়ারির শেষ দিকে ভুট্টো তার দলবলসহ ঢাকায় আসেন এবং জানুয়ারির ২৭ ও ২৮ তারিখে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হনবৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান এবং শাসনতন্ত্র ৬ দফা ভিত্তিক হবে বলে জানানআর ভুট্টো বলেন, 'আরো আলোচনার প্রয়োজন' এবং তিনি ফেব্রুয়ারির শেষদিকের আগে পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের বিরোধিতা করেনএরপর ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে এক সরকারী ঘোষণায় জানানো হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ৩ মার্চ বুধবার ৯টায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছেনএদিকে ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেনওয়ার্কিং কমিটি আলোচনা অনুমোদন করে এবং বঙ্গবন্ধুকে "জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অধিকার আদায়ের জন্য যেকোন পন্থা গ্রহণের পূর্ণ অধিকার প্রদান করে।" ১৫ ফেব্রুয়ারি ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু চক্রান্তকারীদের এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দেন যে, "ফ্যাসিস্ট পন্থা পরিহার করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগুরুর শাসন মেনে নিয়ে দেশের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখুনজনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যবস্থা বানচাল করার যেকোন উদ্দেশে তপর গণতান্ত্রিক রায় নস্যাকারিগণ আগুন নিয়ে খেলবেন না।"

তিনি আরো বলেন, "দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দেওয়া অধিকারবলে আমরা ৬ দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবোসাত কোটি বাঙালির বুকে মেশিনগান বসিয়েও কেউ ঠেকাতে পারবা না।" অন্যদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে, "আওয়ামী লীগের ৬ দফার ব্যাপারে আপোষ বা পুনর্বিন্যাসের আশ্বাস পাওয়া না গেলে তার দল জাতীয় পরিষদের আসন্ন ঢাকা অধিবেশনে যোগদান করতে পারবে না।" ১৭ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো তার পার্টি অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, " মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন শুরু হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে পিপল্স পার্টির জন্য তাতে যোগদান করা একেবারেই অর্থহীন।" এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো তার সহকর্মিদের উদ্দেশে বলেন, "আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি ও সেনাবাহিনী_ দেশে এই তিনটি শক্তিই আছে, আমরা কোন চতুর্থ শক্তির কথা স্বীকার করি না।" জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে অস্বীকার জ্ঞাপন করলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার জন্য ভুট্টোকে আমন্ত্রণ জানান১৯ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে ৫ ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়সম্ভবত ১৭ জানুয়ারি লারকানা বৈঠক এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকেই বাঙালি হত্যার চক্রান্ত ও নীলনকশা চূড়ান্ত রূপ লাভ করেপিন্ডি থেকে করাচি ফিরে গিয়ে ভুট্টো স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, "জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোন ইচ্ছা তাঁর নেই।" ক্রমেই এটা স্বতঃস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পাকিস্তানের সামরিক চক্র '৭০-এর নির্বাচনে বাঙালির অকুণ্ঠ রায়কে বানচাল করার জন্যে ভুট্টোকে ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করছে এবং জনাব ভুট্টো নিজেও সানন্দে ব্যবহূত হচ্ছেন

ঘটনার ধারাবাহিকতায় দেখা যায় যে, ৭০-এর নির্বাচনের ঐতিহাসিক রায় বানচালের ষড়যন্ত্র যতই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, বঙ্গবন্ধু ততই কঠোর-কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে এগুচ্ছিলেনফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়হিয়া খান তার মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেন এবং পিন্ডিতে গভর্নর-সামরিক প্রশাসকদের নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেনঐ বৈঠকে লারকানা ও রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করা হয়সামরিক চক্রের সাথে মিলে ভুট্টো যে ভূমিকায় লিপ্ত তাতে এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কোনভাবেই বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে নাএবং ১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এহেন বক্তব্যে তাক্ষণিক ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরী৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে, শাসনতন্ত্র তৈরী করার জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে মিলিত হবে, জনমনে কাঙ্ক্ষিত এরকম একটি অভিপ্রায়কে সমাধিস্থ করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণায় দাবানলের মতো জ্বলে উঠলো বাংলার মানুষ, তারা ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়লো

১ মার্চ ১৯৭১

ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা অনুযায়ী বাংলার মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য ৭১-এর ১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেনইয়াহিয়া খান তার ভাষণে বলেন, "আমি আমাদের জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের তারিখ ৩ মার্চ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলামবিগত কয়েক সপ্তাহে অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছেকিন্তু আমাকে দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, ঐকমত্যে পেঁৗছবার পরিবর্তে আমাদের কোন কোন নেতা অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেছেন সংক্ষেপে বলতে গেলে পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, অর্থা পাকিস্তান পিপল্স পার্টি এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেনএছাড়া ভারত-সৃষ্ট উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সার্বিক অবস্থাকে আরো জটিল করে তুলেছেঅতএব আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান পরবতর্ী কোন তারিখের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।" সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে কোনরূপ আলোচনা ব্যতিরেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক একতরফাভাবে ঘোষিত এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাক্ষণিকভাবে বাংলার মানুষ ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে

এদিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সভায় ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিলজাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয়ে শেস্নাগানে শেস্নাগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তুলছিলতখন বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহ্বান জানানতিনি বলেন, "অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণায় সারা দেশের জনগণ ক্ষুব্ধআমি মর্মাহতপ্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেনআমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছিসংগ্রাম করেই মুক্তি আনবো আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন।" পরে এক সংবাদ সম্মেলনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রাথমিক কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং বলেন, "৬ মার্চ পর্যন্ত সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল আর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পরবতর্ী কর্মসূচি ঘোষণা করবেনবিকাল ৩ টায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা হবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পল্টন ময়দানের স্বতঃস্ফূর্ত জনসভায় যোগদান করিসেখানে আমি আমার বক্তৃতায় বলি, "আর ৬ দফা ও ১১ দফা নয়এবার বাংলার মানুষ ১ দফার সংগ্রাম শুরু করবেআর এই ১ দফা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাআজ আমরাও শপথ নিলাম_ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।" শত-সহস্র মিছিলে জনসমুদ্রে পরিণত হলো পল্টন ময়দান প্রতিবাদ সভায় আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশ মতো আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাইবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ডেকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেননেতার নির্দেশ পেয়ে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সর্বজনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আসম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক বৈঠকে বিকেলে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে 'স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করেএকমাত্র ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দই সব ধরনের ঝুঁকির মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নেয়

২ মার্চ ১৯৭১

এদিন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় এবং তাঁর নির্দেশে সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলিত হয়বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এ পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব প্রদান করেন ছাত্রলীগ সভাপতি জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক জনাব শাজাহান সিরাজ, ডাকসু সহ-সভাপতি জনাব আসম আব্দুর রব এবং সাধারণ সম্পাদক জনাব আব্দুল কুদ্দুস মাখনপরে এ পতাকা নিয়ে আন্দোলিত রাজপথ মুখর হয়ে ওঠে শেস্নাগানে শেস্নাগানে, 'জাগো জাগো, বাঙালি জাগো'; 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা'; 'স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব'; 'বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে'; 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি'; 'তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ'; 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, সোনার বাংলা মুক্ত করো'; 'পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা'; 'পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা'; 'ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'; 'স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ছাত্র নেতৃবৃন্দের বিশাল একটি মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সমবেত হয়এদিন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিতে ২ জন নাগরিক প্রাণ হারানোর সংবাদে বঙ্গবন্ধু তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি প্রদান করেন এবং ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে অর্ধদিবস হরতালের কর্মসূচী ঘোষণা করেন

সামরিক কর্তৃপক্ষ সান্ধ্য আইন জারি করলে জনতা তা অমান্য করে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর কুশপুত্তলিকা দাহ করে রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং সেনাবাহিনী বিনা উস্কানিতে গুলিবর্ষণ করলে নগরীর বিভিন্ন স্থানে মিছিল সহিংস হয়ে ওঠে

৩ মার্চ ১৯৭১

এদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়ছাত্রলীগের তকালীন সভাপতি জনাব নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জনাব শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেনইশতেহারে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচিত করা হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি" গানটিলাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ অনুষ্ঠানটি ছিল আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এক উলেস্নখযোগ্য দিনএদিনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে তাঁর বক্তৃতায় অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবী করেনআর জনতার উদ্দেশে অফিস-আদালত বন্ধ রেখে, খাজনা-ট্যাক্স না দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেনএদিনের ঐতিহাসিক সভায় আমার বক্তৃতায়ও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের প্রতিধ্বনি করে কর্মসূচী সফল করতে দেশবাসির প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাইএদিন বাংলার মাটি শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলীতে ৭১ জন নিহত হয়সারাদেশ অগি্নগর্ভ হয়ে ওঠে

৪ মার্চ ১৯৭১

এদিনও বঙ্গবন্ধু ঘোষিত পূর্ব কর্মসূচী অনুযায়ী সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়ঢাকায় সাময়িকভাবে কারফিউ তুলে নেওয়া হলেও চট্টগ্রাম, খুলনা ও রংপুরে তা বলব থাকেখুলনায় হরতাল পালনকালে নিরস্ত্র জনতার উপর সেনাবাহিনীর বিক্ষিপ্ত গুলীবর্ষণে ৬ জন নিহত হয় ও ২২ জন আহত হয় চট্টগ্রামে এদিনও সেনাবাহিনীর গুলীবর্ষণে গতকাল আর আজ মিলে সর্বমোট ১২০ জন নিহত ও ৩৩৫ জন আহত হয়সারাদেশে আহতদের সুচিকিসার্থে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শত সহস্র মানুষ লাইন দিয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও নিহতদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়এরকম উত্তাল পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে আওয়ামী লীগের এক মুলতবী সভায় ভবিষ্য কর্মসূচী ব্যাখ্যা করে সংগ্রামের নুতন দিক-নির্দেশনায় বলেন, "আজ আওয়ামী লীগ নয়, গোটা বাঙালি জাতিই অগি্ন-পরীক্ষার সম্মুখীনআমাদের সামনে আজ দু'টো পথ খোলা আছেএকটি সর্বাত্মক ত্যাগ স্বীকারের জন্য নিজেদের মনোবল অটুট রেখে অবিচলভাবে পূর্ণ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া অথবা ভুট্টো-ইয়াহিয়ার কথামত সব কিছু মেনে নেওয়া।" নিজের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "আপনারা জানেন, আমি সারা জীবন ক্ষমতার মসনদ তুচ্ছ জ্ঞান করে দেশ ও জাতির কাছে আমার জীবন মর্টগেজ রেখেছিবাংলার মানুষ গুলী খেয়ে বন্দুকের নলের কাছে বুক পেতে দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফাঁসি কাষ্ঠ থেকে আমাকে মুক্ত করে এনেছেআমার ৬ দফা কর্মসূচীর প্রতি ম্যান্ডেট দিয়েছেএখন শহীদের পবিত্র আত্মত্যাগের প্রতি অশ্রদ্ধা জানিয়ে পাকিস্তানীদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে অবমাননাকর শর্তে কী করে ক্ষমতায় যাই?" অতঃপর বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের মধ্যে সারাদেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাঠামো তৈরির নির্দেশ প্রদান করেনএদিনের উলেস্নখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের নুতন নামকরণ করেন 'ঢাকা বেতার কেন্দ্র' পাকিস্তান টেলিভিশনের নাম পাল্টে 'ঢাকা টেলিভিশন' নাম দিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতে থাকেকার্যত সারা বাংলা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে

৫ মার্চ ১৯৭১

এদিন হরতাল কর্মসূচী পালনকালে টঙ্গীতে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে ৬ জন নিহত ও ৩৫ জন আহত হনখুলনা ও রাজশাহীতেও যথাক্রমে ২ জন ও ১ জন নিহত হনটঙ্গীতে ২০ হাজারেরও বেশী শ্রমিক স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিক্ষোভ মিছিল বের করলে সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলীবর্ষণ করেএ ঘটনার প্রতিবাদে বিকালে আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম থেকে এক বিশাল লাঠি মিছিল বের হয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে ব্যাংকিং লেনদেনের ওপর নুতন নির্দেশ দেওয়া হয়দলের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ এদিন চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেট ও দেশের অন্যান্য স্থানে সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের চিত্র তুলে ধরেনযে কোন জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আওয়ামী লীগ একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেএদিন তাহরিক-ই-ইশতিকলাল পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল (অবঃ) আসগর খান পাকিস্তানের সংহতি বিপন্ন উলেস্নখ করে অবিলম্বে শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান

৬ মার্চ ১৯৭১

সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়বিগত কয়েকদিনে সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেসাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ সকলেই স্ব-স্ব অবস্থান থেকে প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হতে থাকেন 'দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলার জনগণকে দায়ী করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এদিন বেতারে ভাষণ দেন৫ মার্চ ইয়াহিয়া এবং জনাব ভুট্টো ৫ ঘন্টা গোপনে বৈঠক করে যে খসড়া তৈরি করেছিলেন বক্তৃতায় সেটিই প্রতিফলিত হয়এদিন ঢাকাসহ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙ্গে ৩৪১ জন কারাবন্দী পলায়নকালে পুলিশের গুলিতে ৭ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও '' অঞ্চলের সামরিক শাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে সরিয়ে তদস্থলে 'বেলুচিস্তানের কসাই'খ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে উভয় পদে নিযুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয় এয়ার মাশর্াল আসগর খান বঙ্গবন্ধুর সাথে দ্বিতীয় দফা বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, "পরিস্থিতি রক্ষায় আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিবাকি বিষয় আগামীকাল শেখ মুজিবের বক্তৃতায় জানতে পারবেন।" কার্যত, সারাদেশের মানুষ এদিন থেকে অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে পরবতর্ী দিকনির্দেশনা জানারএদিন আমি এক বিবৃতিতে ৭ মার্চের ভাষণ রেসকোর্স থেকে সরাসরি প্রচারের জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানাই




বাংলাদেশ ৭ মার্চ ১৯৭১

১৯৭১-এর সাতই মার্চের বসন্তে জাতির হূদয় জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত হয়েছিল, উত্তাল হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ডাকে অগি্নঝরা উত্তাল মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের ঊর্মিমুখর দিনগুলো আজও চোখে ভাসেবাঙালি জাতি

ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একই সঙ্গে স্বাধীনতার মন্ত্রে এক সুতোয় বাঁধা পড়ার দিন সাতই মার্চসেদিন তাঁর অঙ্গুলি হেলনে কার্যত পাকিস্তানের পতন ঘটেছিলতাঁর বজ্রকণ্ঠে সেদিন ফুঁসে উঠেছিল পদ্মা-মেঘনা-যমুনাযে বজ্রকণ্ঠের উচ্চ নিনাদে নগর-বন্দর থেকে গ্রামের মেঠো পথে মানুষের হূদয় জাতীয় মুক্তির নেশায় জেগে উঠেছিলরেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) মঞ্চ ঘিরে সেদিন সকাল থেকেই বিক্ষুব্ধ বাংলার সংগ্রামী জনতা এক স্রোতে এসে মিশেছিলসে কি উন্মাদনা! সে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ! কী উত্তেজনাময় দিনই না ছিল জাতির জীবনেএক কঠিন সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঙালির প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার স্বপ্ন সামনে রেখে কী বলবেন তাঁর জনগণকে? এই প্রশ্নটিই ছিল সবার কৌতূহলী মনেএকটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও আদর্শ সামনে নিয়ে যারা সংগ্রাম করে- শত অত্যাচার-নির্যাতনের দুঃসহ যন্ত্রণা তাদের গতিপথকে রোধ করতে পারে নাতাই কারাগারের অন্ধকার নিঃসঙ্গ মুহূর্তেও নয়, কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী শাসকদের কাছে মাথানত করেননিকোনো কিছুই তাঁকে তাঁর অঙ্গীকার আর লক্ষ্য থেকে সরাতে পারেনিঢাকা শহরে শেস্নাগান আর শেস্নাগানসংগ্রামী বাংলা সেদিন ছিল অগি্নগর্ভ, দুর্বিনীত কারও চাপিয়ে দেয়া অন্যায় প্রভুত্ব মেনে নেয়ার জন্য, কারও কলোনী বা করদ রাজ্য হিসাবে থাকার জন্য বাংলার মানুষের জন্ম হয়নিবাংলার অপরাজেয় গণশক্তি সেদিন সার্বিক জাতীয় মুক্তি অর্জনের ইস্পাত-কঠিন শপথের দীপ্তিতে ভাস্বর প্রিয় নেতাকে যেন দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ প্রদান করে উচ্চকণ্ঠ হয়েছিল এই শেস্নাগানে, 'জাগো জাগো, বাঙালি জাগো'; 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা'; 'তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব'; 'বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে'; 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি'; 'তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ'; 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, সোনার বাংলা মুক্ত করো'; 'পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা'; 'পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা'; 'ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'; 'স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'ইয়াহিয়ার ঘোষণায় জনতার রুদ্র রোষে ঢাকা হয়ে পড়ে বিক্ষুব্ধ মিছিলের নগরীআজ সাতই মার্চের সেই দিনটির কথা ভাবলে বিস্ময় জাগে! বঙ্গবন্ধু সেদিন নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বীরের জাতিতে পরিণত করেনসেদিন রেসকোর্স ময়দানে ছুটে আসা ১০ লাখেরও বেশি জনতা ছিল যেন প্রতিটি ঘরে ঘরে স্বাধীনতার বার্তা পেঁৗছে দেয়ার একেকজন দূতস্বাধীনতার ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার উন্মাদনা ছড়িয়েছিলেনসেই উন্মাদনা গোটা জাতির রক্তে ছড়িয়েছিলনেতা জানতেন তার মানুষের ভাষাজনগণ বুঝতো নেতার ইশারানেতার কণ্ঠের মাধুর্য তাদের জানা ছিলতাই জাতি সেদিনই নেতার ডাক পেয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেআর সেদিনের রেসকোর্স ময়দান যেন আবহমান বাংলার বাসন্তী সূর্য আর উদার আকাশকে সাক্ষী রেখে নির্ভীক নেতা এবং বীর বাঙালির কণ্ঠে একই সুরে ধ্বনিত হয়ে ওঠে যুগ-যুগান্তর, দেশ-দেশান্তরের সকল মুক্তিপিপাসু সভ্য জাতির অমোঘ মন্ত্র:"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" দিগন্ত কাঁপিয়ে নিযুত কণ্ঠে ধ্বনি ওঠে 'জয় বাংলা' সাতই মার্চ তাই বাংলাদেশের সার্বিক মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে দুর্গম প্রস্তর পথের প্রান্তে অতুলনীয় স্মৃতিফলকসেদিন ছিল রবিবারসকাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনটি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সরগরম পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী বেলা ২টায় সভা শুরু হওয়ার কথাজ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দসহ আমাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে বঙ্গবন্ধু জনসভার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেনরাজ্জাক ভাই, সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, মনি ভাই, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবদুর রউফ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, সিরাজুল আলম খানসহ আমরা একটি গাড়িতে রওয়ানা করিনিরাপত্তার জন্য রাজ্জাক ভাই ও গাজী গোলাম মোস্তফা ড্রাইভারকে ৩২ নম্বর সড়কের পশ্চিম দিক দিয়ে যেতে বলেনরেসকোর্স ময়দানে সেদিন মুক্তিকামী মানুষের ঢল নেমেছিলআকারের বিশালত্ব, অভিনবত্বের অনন্য মহিমা আর সংগ্রামী চেতনার অতুল বৈভবে এই গণমহাসমুদ্র ছিল নজিরবিহীন চারদিকে লক্ষ-মানুষের গগনবিদারী কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে 'জয় বাংলা' শেস্নাগান কার্যত ১৯৬৯ থেকেই 'জয় বাংলা' শেস্নাগানটি ছিল বাঙালির রণধ্বনিবীর বাঙালির হাতে বাঁশের লাঠি এবং কণ্ঠে জয় বাংলা শেস্নাগান যেন প্রলয় রাত্রির বিদ্রোহী বঙ্গোপসাগরের সঘন গর্জনসাতই মার্চ সকাল থেকেই সারাদেশের জনস্রোত এসে মিলিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দানেরেসকোর্স ময়দান যেন বিক্ষুব্ধ বাংলার চিত্রসেদিন প্রিয় নেতা হূদয় আর চেতনা থেকে যে ডাক দিয়েছেন তা সমগ্র জাতি সানন্দে গ্রহণ করেছেসকাল থেকেই কী এক উত্তেজনায় টালমাটাল দেশ! কী বলবেন আজ বঙ্গবন্ধু? এই প্রশ্ন নিয়ে লাখ লাখ জনতার মিছিল ছুটে আসে রেসকোর্স ময়দানের দিকেবঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা সভামঞ্চে এলাম ৩টা ১৫ মিনিটেদীর্ঘ ২৩ বছরের শত সংগ্রাম শেষে দৃঢ়তার সঙ্গে আপোষহীন অবয়ব নিয়ে নেতা এসে দাঁড়ালেন জনতার মঞ্চেজনতার হূদয়ে যেন আকাশ স্পর্শ করার আনন্দ দোলা দিয়ে গেলকিন্তু ঊর্মিমুখর জনতার মধ্যে অধৈর্যের কোনো লক্ষণ দেখিনিনির্দিষ্ট সময়ের বহু আগেই অর্থা সকাল থেকে জনতার স্রোত এসে মিলিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দানেজনস্রোতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় সভাস্থলমানুষ গাছের উপরে উঠে বসে নেতার বক্তৃতা শোনার জন্যসেদিনের সেই গণ-মহাসমুদ্রে আগত মানুষের বয়স, পেশা, সামাজিক মর্যাদা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও শ্রেণীগত অবস্থানের যতই ফারাক থাকুক না কেন, সে জনতার মধ্যে আশ্চর্য যে সুশৃঙ্খল ঐকতান ছিল তা হচ্ছে, হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠের শেস্নাগান আর অন্তরের অন্তরতম কোণে লালিত জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাসাদা পাজামা-পাঞ্জাবির পর কালো মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন, বাংলার বীর জনতা বজ্রনির্ঘোষে তুমুল করতালি ও শেস্নাগানের মধ্যে তাঁকে বীরোচিত অভিনন্দন জ্ঞাপন করেতাঁর চোখে-মুখে তখন সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের সুযোগ্য সর্বাধিনায়কের দুর্লভ তেজোদৃপ্ত কাঠিন্য আর সংগ্রামী শপথের দীপ্তির মিথস্ক্রিয়ায় জ্যোতির্ময় অভিব্যক্তি খেলা করতে থাকেআমরা হিমালয়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে শুনে যাচ্ছি তাঁর সেই দুনিয়া কাঁপানো ভাষণযে ভাষণকে বিশেষজ্ঞগণ তুলনা করেন আব্রাহাম লিংকনের 'গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস'-এর সঙ্গেঅমন সাজানো-গোছানো নির্ভুল, ছন্দোবদ্ধ, প্রাঞ্জল, উদ্দীপনাময় ভাষণটি তিনি রাখলেনকী আস্থা তাঁর প্রিয় স্বদেশের মানুষের প্রতি, প্রধানমন্ত্রিত্ব এমনকি জীবনের চেয়েও কত বেশী প্রিয় তাঁর মাতৃভূমির স্বাধীনতা তাই তিনি শোনালেনএতটাই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ছিলেন যে, ভাষণে তিনি একদিকে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, অন্যদিকে শাসকের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করার পাতানো ফাঁদেও পা দিলেন না'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' যেমন বললেন; তেমনি চার শর্তের জালে ফেললেন শাসকের ষড়যন্ত্রের দাবার ঘুঁটিবললেন- সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে; সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে; নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে; গণহত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবেরক্তের দাগ না মোছা পর্যন্ত অধিবেশনে যোগ না দেয়ার কথাটিও বললেনক্যান্টনমেন্টে তখন গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলার প্রস্তুতিকিন্তু নেতার বিচক্ষণতায় রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হলোসাতই মার্চের ভাষণ নয়, যেন মহানায়কের বাঁশিতে উঠে আসা স্বাধীনতার সুরসেই সুরে বীর বাঙালির মনই শুধু নয়, রক্তেও সশস্ত্র স্বাধীনতার নেশা ধরিয়ে দিলোভাষণটি বঙ্গবন্ধু নিজ সিদ্ধান্তেই দিয়েছেনবঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের সহযাত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জানিয়েছিলেন, ৬ মার্চ সারা রাত বঙ্গবন্ধু বিচলিত-অস্থির ছিলেন, তিনি কী বলবেন তাঁর জনগণকে তা নিয়েবেগম মুজিব বলেছিলেন, 'তুমি যা বিশ্বাস করো তাই বলবে' সেই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো শিহরিত হইএখনো কানে বাজে নেতা বলছেন, 'আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবেআমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, বাংলার মানুষের অধিকার চাই' সেদিন রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের মহাসমাবেশ ঘটেছিল সার্বিক জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবতর্ী কর্মসূচি সম্পর্কে পথনির্দেশ লাভের জন্য আমরা যারা সেদিনের সেই জনসভার সংগঠক ছিলাম, যারা আমরা মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পদতলের পাশে বসে ময়দানে উপস্থিত জনতার চোখে-মুখে প্রতিবাদের-প্রতিরোধের যে অগি্নশিখা দেখেছি তা আজও স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে আছেকিন্তু তারা ছিল শান্ত-সংযত- নেতার পরবতর্ী নির্দেশ শোনার প্রতীক্ষায় তারা ছিল ব্যাগ্র-ব্যাকুল এবং মন্ত্রমুগ্ধকী উত্তেজনাময়, আবেগঘন মুহূর্ত ছিল সেদিনবঙ্গবন্ধু যখন বক্তৃতা শুরু করলেন জনসমুদ্র যেন প্রশান্ত এক গাম্ভীর্য নিয়ে পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে গেলএতো কোলাহল, এতো মুহুমর্ুহু গর্জন নিমেষেই উধাওআবার পরক্ষণেই সেই জনতাই সংগ্রামী শপথ ঘোষণায় উদ্বেলিত হয়েছে মহাপ্রলয়ের উত্তাল জলধির মতো, যেন 'জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার'তাইতো জোয়ার-ভাটার দেশ এই বাংলাদেশ, আশ্চর্য বাঙালির মন ও মানস সাতই মার্চের রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে সম্বোধন করেছেন, 'ভাইয়েরা আমার' বলেসাড়ে সাত কোটি বাঙালির নির্যাতিত-মুমূর্ষু-বিক্ষুব্ধ চেতনাকে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে নির্দেশ দিয়েছেন, "ঃপ্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলোতোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।" ১১০৮টি শব্দ সম্বলিত প্রায় ১৯ মিনিটের এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন বাঙালি জাতি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল বঙ্গবন্ধু যখন জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের রূপরেখা আর নিজের চরম ত্যাগের কথা ঘোষণা করছিলেন তখন তাঁর কণ্ঠ কাঁপেনি, থামেনি- জনশক্তির বলে বলীয়ান গণনায়কের কণ্ঠ বজ্রের হুঙ্কারের মতোই গর্জে উঠেছিলইতিহাসের আশীর্বাদস্বরূপ নেতা আর জনতার শিরোপরি যেন বসন্তের আকাশ হতে বিদায়ী সূর্যের আলোকরশ্মি ঝরে পড়ছিলঐতিহাসিক সেই দুর্লভ প্রাঙ্গণটিতে আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল নেতার পদপ্রান্তে বসে সাড়ে সাত কোটি বঞ্চিত-অবহেলিত-নিরন্ন নর-নারীর অবিসংবাদিত নেতার দুর্জয় সঙ্কল্পবদ্ধ অপরূপ রূপ প্রত্যক্ষ করার সাতই মার্চ অনন্য-অবিস্মরণীয়

[লেখক: আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য, সভাপতি, শিল্প মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি]

No comments:

Post a Comment

Photographs, Audio, Video and Text on Bangabandhu  ***Please use Vrinda Font if there is a problem to read Bangla ***       Click o...