১৫ আগস্ট বাঙালী জাতির জীবনে শোকাবহ এক কলঙ্কিত দিন। সেদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘাতকের বুলেটে নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলার মানুষের প্রতি ছিল যার নিঃস্বার্থ ভালবাসা, তাদের মঙ্গলের জন্য দরদী মন। দুঃখী দারিদ্র্যক্লিষ্ট বাংলার মানুষের মুখে তিনি হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। বাংলার ঘরে ঘরে শান্তি ও স্বস্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। বিশ্বে বাঙালী তার মেধা, শ্রম ও প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে_ এই ছিল তাঁর স্বপ্ন।
পাকিস্তানী স্বৈর-সামরিক শাসকগোষ্ঠীর শোষণ থেকে বাঙালীকে তিনি মুক্ত করেছেন। বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্ন স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। তাঁরই নির্দেশে যার যা কিছু ছিল তাই দিয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করে বাংলার সাহসী সন্তানরা দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন করেছে। বাঙালী বীরের জাতি হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে নন্দিত হয়েছে। সেই জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি আজীবন সংগ্রাম-আন্দোলন করেছেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বার বার কারাবন্দী হয়েছেন, পাকিসত্মানী শাসকচক্রের রোষানলের শিকার হয়েছেন। তাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কারণে দুঃসহ নির্যাতন ভোগ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ তোলা হয়েছে। ১৯৭১ সালে গোপন বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে এবং কবর পর্যন্ত খনন করা হয়েছিল।
এই আত্মত্যাগী নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক মানুষটির অপরাধ ছিল তিনি তাঁর দেশবাসীকে খুব বেশি ভালবাসতেন। তাই তাদের মুক্তির দাবি উচ্চারণ করেছেন। তাদের ওপর দমন-পীড়ন বৈষম্য শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিলেন। তিনি বাঙালীর প্রিয় নেতা ছিলেন, প্রিয় বন্ধু ছিলেন। কোন শাসকই তাঁকে দমাতে পারেনি, তাঁর মাথা কখনও নত হয়নি, ক্ষমতার লোভে তাঁকে কেউ বশ করতে পারেনি_সব কিছুর উর্ধে তিনি ছিলেন এক সাহসী ও আদর্শবাদী নেতা। এক দূরদর্শী কাণ্ডারী, যিনি তাঁর লক্ষ্যে ছিলেন পর্বতসমান অটল, দৃঢ় ও শক্তিশালী। তাঁর পেছনে ছিল মানুষ, সামনে ছিল মানুষ, পাশে ছিল মানুষ। বাংলার মানুষের হৃদয়ে ছিল তাঁর অবস্থান। মানুষের সমুদ্রে দাঁড়িয়ে তিনি হয়েছেন এক মহামানব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসেবে বিবিসির শ্রোতা জরিপে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। পোশাক পরিচ্ছদ, চলনে বলনে এবং জীবনাচরণে মনেপ্রাণে একজন খাঁটি বাঙালী ছিলেন তিনি। ছোটবেলায় আমরা তো আব্বা হিসেবেই তাঁকে দেখেছি, জেনেছি, কাছাকাছি থেকে স্নেহ যত্ন পেয়েছি। এখন উপলব্ধি করতে পারি তিনি কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন। গর্বে আমার বুকটা ভরে ওঠে।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বাঙালীর এই প্রিয় নেতাকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকের দল চেয়েছিল বাংলাদেশকে পদানত রাখতে, দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষে-দুঃখে ক্ষতবিক্ষত করতে, বাংলার সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ও মূল্য বোধকে ধ্বংস করে দিতে। কিন্তু পারেনি। বাঙালী শোকাচ্ছন্ন হয়েছে, মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, তাদের প্রিয় নেতার হত্যার দাবি তুলেছে, অপরাধীদের শাসত্মি চেয়েছে। বাঙালীর প্রতিষ্ঠা চেয়েছে। কালের পরিক্রমায় তাদের দাবি পূরণ হয়েছে। বিচার হয়েছে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও নিরপেৰভাবে। সত্য কখনও কিছু দিয়ে দাবিয়ে রাখা যায় না_ একদিন তা প্রকাশিত হবেই। সত্য বড় কঠিন। কিন্তু সত্যই কেবল পারে মিথ্যাকে মুছে ফেলতে। ঘাতকরা ভেবেছিল হত্যা করে শেষ করে দেবে। বিচার হবে না কিন্তু পুরস্কৃত হবে। সেটা কখনও হয়?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার এই কালো অধ্যায় বাঙালীর জীবনে অনেক দুর্ভোগ বয়ে এনেছে কিন্তু তাঁর চেতনাকে ধ্বংস করতে পারেনি। পাঠ্যপুসত্মকে ইতিহাস বিকৃতি করা হয়েছে কিন্তু মুছে ফেলতে পারেনি জাতির পিতার ছবি, নাম ও কীর্তি। এই হত্যার শোক আরও গভীরভাবে অনুভূতির আলোয় আলোকিত হয়েছে বাঙালীর অন্তরে, বাংলার মাটি_ঘাস ফসলের প্রান্তর_নদীর স্রোতধারায় সদা উজ্জ্বল হয়ে আছেন তিনি। শ্রদ্ধায়-মর্যাদায়-সম্মানে তিনি প্রতিনিয়ত স্মরণীয় হয়ে আছেন।
দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আজও আমরা পিতা-মাতা-ভাইদের শোকাশ্রম্ন হৃদয়ে লালন করে আসছি। হারানোর বেদনা বড় কঠিন, এমন নৃশংস হত্যা আর যেন কোথাও কখনও না ঘটে। আমরা যে বেদনার নীল দংশনে সর্বদা জর্জরিত হয়েছি, তা যেন আর কাউকে স্পর্শ না করে। আমার পিতা রাজনীতি করতেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন_ সেটাই কি ছিল তাঁর অপরাধ? কিন্তু আমার মা ও ভাইদের কি অপরাধ ছিল? ছোট্ট দশ বছরের শিশু রাসেলকেও তারা রেহাই দেয়নি। নিরীহ নারী ও শিশু হত্যা যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে থাকে তাহলে এই হত্যাকা-কে কোন আখ্যা দিয়ে নিন্দা করা যেতে পারে?
আমার মা সারা জীবন কত কষ্ট করেছেন । আব্বার রাজনৈতিক সংগ্রাম ও জীবনের পেছনে তাঁর একটা ভূমিকা ছিল। তাঁর আত্মত্যাগ আমাদের কাছেও একটা উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আব্বা বা কারম্নর কাছে তাঁর কোন অভিযোগ ছিল না। নীরবে হাসিমুখে ধৈর্যের সঙ্গে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো শক্তি ছিল তাঁর। প্রাণ ভিক্ষাও চাননি ঘাতকদের কাছে। বরং মাথা উঁচু করে তাদের সঙ্গী হয়ে চলে গেলেন। এমনই সাহসী ছিলেন আমার মা। ভাইদের কথা মনে হলে বুক ভরে আসে বেদনায়। তাদের স্নেহ মমতায় বড় হয়ে উঠেছি। একসঙ্গে খেলেছি, দুষ্টুমি, লেখাপড়া, মান অভিমান সবকিছু মিলে আমাদের পরিবারে একটা আত্মিক সম্পর্ক ছিল। সবার জন্য সবার হৃদয় ছিল উদার প্রকৃতির। আমার বড় ভাবী সুলতানা কামাল দেশের একজন খ্যাতিমান ক্রীড়াবিদ ছিলেন। সবাই খুব খুশি হয়ে তাদের সেরা জুটি বলত। মা ও আব্বা পছন্দ করে বউ করে ঘরে তুলে আনেন। জামাল ভাইয়ের স্ত্রী ফুফাত বোন রোজী আমার সহপাঠী ছিল। তাদের সঙ্গে করেই আমার মা চলে গেলেন। আমার একমাত্র চাচা শেখ আবু নাসের পায়ের সমস্যা নিয়েও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। আমার ফুফাজান আবদুর রব সেরনিয়াবাত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর মতো শানত্ম ও বিচক্ষণ প্রগতিশীল মানুষকেও ঘাতকরা হত্যা করেছে। মণি ভাই একজন সাহসী ছাত্রনেতা ছিলেন। ফুফাজান ও মণিভাইও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মণিভাইয়ের স্ত্রী আরজু আপা, বেবী, আরিফ ও চার বছরের ছোট্ট সুকানত্ম কার কথা বাদ দেব। কর্নেল জামিল আব্বার টেলিফোন পেয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে না থেকে প্রাণের মায়া না করে ছুটে এসেছিলেন তাঁকে বাঁচাতে। তিনি আমাকে 'মা' 'মাগো' বলে ডাকতেন। এখনও তার সেই কণ্ঠ কানে বাজে আমার। তাঁর কথা ভুলব কি করে? এইসব হত্যার শোক আমাদের এখনও বেদনাহত করে রাখে। মানুষের জীবনে মৃত্যু স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এক সকালে ঘুম থেকে তুলে সবাইকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা হবে? এ কেমন কাপুরুষতা।
আজ মনে হয় আমাদের দু 'বোন বেঁচে আছি কেন? শুধু তাদের রক্তাক্ত স্মৃতি বয়ে বেড়াবার জন্য। এইভাবে যতদিন বাঁচব_ তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাব। বত্রিশ নম্বর সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে, বনানীতে সারি সারি মাজারের সামনে দাঁড়িয়ে, টুঙ্গিপাড়ায় মাজারের সামনে বসে চোখে জল নিয়ে তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করে যাব?
আমাদের এখন শুধু শক্তি ধারণ করতে হবে । বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সবার মাঝে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, জানার আগ্রহ বাড়ছে। তাঁকে যেন তারা সঠিকভাবে জানতে পারে সেই সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। একটি বটবৃৰ বহু দিনের কঠোর পরিচর্যায় বিসত্মৃত হয়ে ওঠে, তেমনি শেখ মুজিব হয়ে ওঠার পেছনে দীর্ঘ দিনের পথটিও ছিল বহু সাধনা-ত্যাগ-দুর্ভোগ ও নির্যাতনের ভেতর দিয়ে। একটি জাতির জন্য মানসিক শক্তি জরম্নরী-সেটা শেখ মুজিব তার আজীবনের রাজনৈতিক কর্মকা- দিয়ে আমাদের সামনে রেখে গেছেন। আমাদের নতুন প্রজন্মকে এই সব তথ্য ও ঘটনার মূল্যায়ন জানাতে হবে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সম্প্রতি এক জরিপে এই প্রজন্মের তরুণরা শেখ মুজিব ও কবি নজরুলকে তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণের পৰে মত দিয়েছে। এটা অত্যান্ত আনন্দের কথা।
আমাদের দেশটা সুন্দর , তার সংস্কৃতি ও সমাজটাও উন্নত। আমাদের মানুষ আরও ভাল, অনেক পরিশ্রমী এবং আত্মত্যাগী। তারা দুঃখ-শোক, বেদনা_দারিদ্র্যকে জয় করতে জানে। তারা সুখ ও আনন্দকে জীবনের রূপ হিসেবে দেখতে চায়। আমাদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে, শক্তি আছে, সাহস আছে_ তারা যদি ঐক্যবদ্ধ হই, সংগঠিত হই তাহলে বিন্দু বিন্দু ভালবাসায় একদিন সবার মনের অন্ধকার ঘোচাতে সমর্থ হব। দেশ-সমাজ-সংস্কৃতি-মানুষ সবই আমাদের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য। আমাদেরই হতে হবে এদের জন্য আত্মত্যাগী ও জনদরদী। আমাদের জাতির পিতার এই আদর্শ আমাদের মধ্যে অনুসৃত হোক। ১৫ আগস্ট শুধুমাত্র শোক ও অশ্রম্ন নয়, আমাদের শক্তি ও সাহস যোগাক। দেশ ও জনকল্যাণে ব্রতী করে তুলুক। আমাদের মানসিক ও শারীরিকভাবে উন্নত করুক, উজ্জীবিত করুক আমাদের জাতির পিতার এই আদর্শ আমাদের মধ্যে ॥
পাকিস্তানী স্বৈর-সামরিক শাসকগোষ্ঠীর শোষণ থেকে বাঙালীকে তিনি মুক্ত করেছেন। বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্ন স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। তাঁরই নির্দেশে যার যা কিছু ছিল তাই দিয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করে বাংলার সাহসী সন্তানরা দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন করেছে। বাঙালী বীরের জাতি হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে নন্দিত হয়েছে। সেই জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি আজীবন সংগ্রাম-আন্দোলন করেছেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বার বার কারাবন্দী হয়েছেন, পাকিসত্মানী শাসকচক্রের রোষানলের শিকার হয়েছেন। তাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কারণে দুঃসহ নির্যাতন ভোগ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ তোলা হয়েছে। ১৯৭১ সালে গোপন বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে এবং কবর পর্যন্ত খনন করা হয়েছিল।
এই আত্মত্যাগী নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক মানুষটির অপরাধ ছিল তিনি তাঁর দেশবাসীকে খুব বেশি ভালবাসতেন। তাই তাদের মুক্তির দাবি উচ্চারণ করেছেন। তাদের ওপর দমন-পীড়ন বৈষম্য শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিলেন। তিনি বাঙালীর প্রিয় নেতা ছিলেন, প্রিয় বন্ধু ছিলেন। কোন শাসকই তাঁকে দমাতে পারেনি, তাঁর মাথা কখনও নত হয়নি, ক্ষমতার লোভে তাঁকে কেউ বশ করতে পারেনি_সব কিছুর উর্ধে তিনি ছিলেন এক সাহসী ও আদর্শবাদী নেতা। এক দূরদর্শী কাণ্ডারী, যিনি তাঁর লক্ষ্যে ছিলেন পর্বতসমান অটল, দৃঢ় ও শক্তিশালী। তাঁর পেছনে ছিল মানুষ, সামনে ছিল মানুষ, পাশে ছিল মানুষ। বাংলার মানুষের হৃদয়ে ছিল তাঁর অবস্থান। মানুষের সমুদ্রে দাঁড়িয়ে তিনি হয়েছেন এক মহামানব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসেবে বিবিসির শ্রোতা জরিপে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। পোশাক পরিচ্ছদ, চলনে বলনে এবং জীবনাচরণে মনেপ্রাণে একজন খাঁটি বাঙালী ছিলেন তিনি। ছোটবেলায় আমরা তো আব্বা হিসেবেই তাঁকে দেখেছি, জেনেছি, কাছাকাছি থেকে স্নেহ যত্ন পেয়েছি। এখন উপলব্ধি করতে পারি তিনি কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন। গর্বে আমার বুকটা ভরে ওঠে।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বাঙালীর এই প্রিয় নেতাকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকের দল চেয়েছিল বাংলাদেশকে পদানত রাখতে, দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষে-দুঃখে ক্ষতবিক্ষত করতে, বাংলার সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ও মূল্য বোধকে ধ্বংস করে দিতে। কিন্তু পারেনি। বাঙালী শোকাচ্ছন্ন হয়েছে, মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, তাদের প্রিয় নেতার হত্যার দাবি তুলেছে, অপরাধীদের শাসত্মি চেয়েছে। বাঙালীর প্রতিষ্ঠা চেয়েছে। কালের পরিক্রমায় তাদের দাবি পূরণ হয়েছে। বিচার হয়েছে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও নিরপেৰভাবে। সত্য কখনও কিছু দিয়ে দাবিয়ে রাখা যায় না_ একদিন তা প্রকাশিত হবেই। সত্য বড় কঠিন। কিন্তু সত্যই কেবল পারে মিথ্যাকে মুছে ফেলতে। ঘাতকরা ভেবেছিল হত্যা করে শেষ করে দেবে। বিচার হবে না কিন্তু পুরস্কৃত হবে। সেটা কখনও হয়?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার এই কালো অধ্যায় বাঙালীর জীবনে অনেক দুর্ভোগ বয়ে এনেছে কিন্তু তাঁর চেতনাকে ধ্বংস করতে পারেনি। পাঠ্যপুসত্মকে ইতিহাস বিকৃতি করা হয়েছে কিন্তু মুছে ফেলতে পারেনি জাতির পিতার ছবি, নাম ও কীর্তি। এই হত্যার শোক আরও গভীরভাবে অনুভূতির আলোয় আলোকিত হয়েছে বাঙালীর অন্তরে, বাংলার মাটি_ঘাস ফসলের প্রান্তর_নদীর স্রোতধারায় সদা উজ্জ্বল হয়ে আছেন তিনি। শ্রদ্ধায়-মর্যাদায়-সম্মানে তিনি প্রতিনিয়ত স্মরণীয় হয়ে আছেন।
দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আজও আমরা পিতা-মাতা-ভাইদের শোকাশ্রম্ন হৃদয়ে লালন করে আসছি। হারানোর বেদনা বড় কঠিন, এমন নৃশংস হত্যা আর যেন কোথাও কখনও না ঘটে। আমরা যে বেদনার নীল দংশনে সর্বদা জর্জরিত হয়েছি, তা যেন আর কাউকে স্পর্শ না করে। আমার পিতা রাজনীতি করতেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন_ সেটাই কি ছিল তাঁর অপরাধ? কিন্তু আমার মা ও ভাইদের কি অপরাধ ছিল? ছোট্ট দশ বছরের শিশু রাসেলকেও তারা রেহাই দেয়নি। নিরীহ নারী ও শিশু হত্যা যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে থাকে তাহলে এই হত্যাকা-কে কোন আখ্যা দিয়ে নিন্দা করা যেতে পারে?
আমার মা সারা জীবন কত কষ্ট করেছেন । আব্বার রাজনৈতিক সংগ্রাম ও জীবনের পেছনে তাঁর একটা ভূমিকা ছিল। তাঁর আত্মত্যাগ আমাদের কাছেও একটা উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আব্বা বা কারম্নর কাছে তাঁর কোন অভিযোগ ছিল না। নীরবে হাসিমুখে ধৈর্যের সঙ্গে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো শক্তি ছিল তাঁর। প্রাণ ভিক্ষাও চাননি ঘাতকদের কাছে। বরং মাথা উঁচু করে তাদের সঙ্গী হয়ে চলে গেলেন। এমনই সাহসী ছিলেন আমার মা। ভাইদের কথা মনে হলে বুক ভরে আসে বেদনায়। তাদের স্নেহ মমতায় বড় হয়ে উঠেছি। একসঙ্গে খেলেছি, দুষ্টুমি, লেখাপড়া, মান অভিমান সবকিছু মিলে আমাদের পরিবারে একটা আত্মিক সম্পর্ক ছিল। সবার জন্য সবার হৃদয় ছিল উদার প্রকৃতির। আমার বড় ভাবী সুলতানা কামাল দেশের একজন খ্যাতিমান ক্রীড়াবিদ ছিলেন। সবাই খুব খুশি হয়ে তাদের সেরা জুটি বলত। মা ও আব্বা পছন্দ করে বউ করে ঘরে তুলে আনেন। জামাল ভাইয়ের স্ত্রী ফুফাত বোন রোজী আমার সহপাঠী ছিল। তাদের সঙ্গে করেই আমার মা চলে গেলেন। আমার একমাত্র চাচা শেখ আবু নাসের পায়ের সমস্যা নিয়েও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। আমার ফুফাজান আবদুর রব সেরনিয়াবাত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর মতো শানত্ম ও বিচক্ষণ প্রগতিশীল মানুষকেও ঘাতকরা হত্যা করেছে। মণি ভাই একজন সাহসী ছাত্রনেতা ছিলেন। ফুফাজান ও মণিভাইও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মণিভাইয়ের স্ত্রী আরজু আপা, বেবী, আরিফ ও চার বছরের ছোট্ট সুকানত্ম কার কথা বাদ দেব। কর্নেল জামিল আব্বার টেলিফোন পেয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে না থেকে প্রাণের মায়া না করে ছুটে এসেছিলেন তাঁকে বাঁচাতে। তিনি আমাকে 'মা' 'মাগো' বলে ডাকতেন। এখনও তার সেই কণ্ঠ কানে বাজে আমার। তাঁর কথা ভুলব কি করে? এইসব হত্যার শোক আমাদের এখনও বেদনাহত করে রাখে। মানুষের জীবনে মৃত্যু স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এক সকালে ঘুম থেকে তুলে সবাইকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা হবে? এ কেমন কাপুরুষতা।
আজ মনে হয় আমাদের দু 'বোন বেঁচে আছি কেন? শুধু তাদের রক্তাক্ত স্মৃতি বয়ে বেড়াবার জন্য। এইভাবে যতদিন বাঁচব_ তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাব। বত্রিশ নম্বর সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে, বনানীতে সারি সারি মাজারের সামনে দাঁড়িয়ে, টুঙ্গিপাড়ায় মাজারের সামনে বসে চোখে জল নিয়ে তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করে যাব?
আমাদের এখন শুধু শক্তি ধারণ করতে হবে । বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সবার মাঝে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, জানার আগ্রহ বাড়ছে। তাঁকে যেন তারা সঠিকভাবে জানতে পারে সেই সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। একটি বটবৃৰ বহু দিনের কঠোর পরিচর্যায় বিসত্মৃত হয়ে ওঠে, তেমনি শেখ মুজিব হয়ে ওঠার পেছনে দীর্ঘ দিনের পথটিও ছিল বহু সাধনা-ত্যাগ-দুর্ভোগ ও নির্যাতনের ভেতর দিয়ে। একটি জাতির জন্য মানসিক শক্তি জরম্নরী-সেটা শেখ মুজিব তার আজীবনের রাজনৈতিক কর্মকা- দিয়ে আমাদের সামনে রেখে গেছেন। আমাদের নতুন প্রজন্মকে এই সব তথ্য ও ঘটনার মূল্যায়ন জানাতে হবে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সম্প্রতি এক জরিপে এই প্রজন্মের তরুণরা শেখ মুজিব ও কবি নজরুলকে তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণের পৰে মত দিয়েছে। এটা অত্যান্ত আনন্দের কথা।
আমাদের দেশটা সুন্দর , তার সংস্কৃতি ও সমাজটাও উন্নত। আমাদের মানুষ আরও ভাল, অনেক পরিশ্রমী এবং আত্মত্যাগী। তারা দুঃখ-শোক, বেদনা_দারিদ্র্যকে জয় করতে জানে। তারা সুখ ও আনন্দকে জীবনের রূপ হিসেবে দেখতে চায়। আমাদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে, শক্তি আছে, সাহস আছে_ তারা যদি ঐক্যবদ্ধ হই, সংগঠিত হই তাহলে বিন্দু বিন্দু ভালবাসায় একদিন সবার মনের অন্ধকার ঘোচাতে সমর্থ হব। দেশ-সমাজ-সংস্কৃতি-মানুষ সবই আমাদের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য। আমাদেরই হতে হবে এদের জন্য আত্মত্যাগী ও জনদরদী। আমাদের জাতির পিতার এই আদর্শ আমাদের মধ্যে অনুসৃত হোক। ১৫ আগস্ট শুধুমাত্র শোক ও অশ্রম্ন নয়, আমাদের শক্তি ও সাহস যোগাক। দেশ ও জনকল্যাণে ব্রতী করে তুলুক। আমাদের মানসিক ও শারীরিকভাবে উন্নত করুক, উজ্জীবিত করুক আমাদের জাতির পিতার এই আদর্শ আমাদের মধ্যে ॥
No comments:
Post a Comment