‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এ বজ্রনির্ঘোষ উচ্চারণই মুক্তিযুদ্ধের সবুজ সংকেত এবং ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা’র দ্বিধাহীন নির্দেশ আর ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’ এমন নিঃসংকোচ বলিষ্ঠ ঘোষণা যিনি নিঃশংকচিত্তে দিতে পারেন তিনিই তো মুক্তির দূত। আমাদের এ দেশে একজন আজ থেকে ৯০ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তারই নাম শেখ মুজিবুর রহমান। যাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে চিনতে পেরেছিলেন এদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা। রাষ্ট্রের প্রথম ও একমাত্র সংবিধান যাকে ‘জাতির জনক’ বলে মান্য করেছে, তিনিই ছিলেন বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। তারই বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণা।
পাকিস্তানি শাসক ও শোষকগোষ্ঠী যখন এই ভূ-খণ্ডের সব বাসিন্দাকে ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে পঙ্গু করতে মাতৃভাষা বাংলাকেই বিলুপ্ত করার অপকৌশল এঁটেছিল, সেদিন থেকেই যে প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংগ্রাম সূচিত হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ছুরিতে কেটে ভাগ করা বাংলার এই অংশে তখন তরুণ বয়স থেকে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম, তারপর একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। কারণ পাকিস্তান আন্দোলনে সোচ্চার বাঙালি এবং বাংলার উদার ও সচেতন মানুষের মোহ ভঙ্গ হতে বেশিদিন লাগেনি। যে প্রত্যাশায় বাংলার অমিততেজ মানুষ মুক্তি চেয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী পরাক্রমশালী শোষক শ্রেণীর হাত থেকে, তা পূরণ তো হয়ইনি, বরং ব্রিটিশ-বিতাড়িত বাংলার এই জমিনে ‘পাকিস্তান’ নামে একটি উদ্ভট দেশের পত্তন ঘটেছিল। তবে ভ্রান্তিবিলাসে বেশিদিন কাটাতে হয়নি আমাদের। আমরা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জানতে এবং বুঝতে পারলাম- কপট পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলার সখ্য সম্ভব নয় এবং বৈরী মানসিকতা তখন থেকে শুরু হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন তরুণ, তবু তেজ-তেজস্বীয়তায় ছিলেন অগ্রণী। বুঝতে পেরেছিলেন, এ রাষ্ট্রব্যবস্থার বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হতে না পারলে ধুঁকে ধুঁকে এ জাতিকে ধ্বংসই হতে হবে। সুতরাং অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই শুরু হয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র পত্তনের কাল থেকেই। ছাত্র-তরুণ বঙ্গবন্ধু তখন শেখ মুজিব, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সে তরুণ আপন নেতৃত্বগুণে চলে এলেন সামনে এবং গণতান্ত্রিক যুদ্ধের অধিনায়কত্ব গ্রহণে দ্বিধা করলেন না। শেখ মুজিব সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন, ব্রিটিশরা যে জিঞ্জির আমাদের হাতে-পায়ে পরিয়ে দিয়ে গেছে, তা থেকে মুক্ত হতে না পারলে জাতি হিসেবে টিকে থাকাই দায় হয়ে যাবে। তাই কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজজীবন থেকে যে পাঠ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেছিলেন, রাজনৈতিক জীবনের সূচনাতেই তার বৈভবে ৪৮-এই গ্রেফতার হয়ে গেলেন শেখ মুজিব। এদিকে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালেই শাসক মুসলিম লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে নতুন রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় ঘটেছিল- পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ সৃষ্টিতে। এ নতুন সংগঠনের প্রথম যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ মুজিব। ইতিহাস বলে, খন্দকার মুশতাক আহমদ সেদিনই মুজিব-বিরোধিতা করেছিলেন। কারণ মুশতাককে মওলানা সাহেব দ্বিতীয় যুগ্ম সচিব করেছিলেন। সেদিনের বিরোধিতায় কি আঁচ করা গিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর ‘হত্যাকারীর’ উদ্ভব ঘটে গেল? তারা ঘনিষ্ঠ ছিলেন দু’জনে কিন্তু জেলে আটক মুজিবকে কেন এক নম্বরে রাখবেন, এটাই ছিল খন্দকারের ক্ষোভ। সেই ক্ষোভ, হিংস্রতায় রূপ নিয়েছিল এবং ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটিয়েই সপরিবারে হত্যা করেছিল হন্তারকরা ১৯৭৫ সালে, ঠিক ২৬ বছর পরে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬-তে ৬ দফা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যেভাবে হন্যে হয়ে তাকে হেনস্থা করতে শুরু করল তাতে ফল হল উল্টো। পূর্ববঙ্গের রাজনীতিসচেতন মানুষ উপলব্ধি করলেন, শোষণ-বঞ্চনার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। সুতরাং আজ আর মাথানত করে নয়, বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর সময় উপস্থিত। দেশে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতা থেকে স্বকীয়তা অর্জনের পথে আন্দোলন ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সেই বিকল্পের নেতৃত্ব দিলেন সেই শেখ মুজিবই। তিনিই হলেন বঙ্গবন্ধু।
ছয়দফা কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলনই পূর্ববঙ্গবাসীকে দিয়েছিল সাহসে বুক বাঁধার শক্তি, আ্তপ্রত্যয়। তাই মানুষ ছুটল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, সংগঠিত হল। আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে দুঃশাসকের দল নির্যাতনে পোড় খাওয়া নেতায় পরিণত করল। জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠলেন তিনি। আইয়ুবি সামরিক শাসন জারি থাকলেও যেন মুজিব-নির্দেশেই দেশ চলবে, এমনই পূর্বাভাস মিলেছিল সেদিন। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সারা পাকিস্তানেই আওয়ামী লীগের জয়জয়কার। শেখ মুজিবই হবেন পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, এমন ঘোষণাই দিয়েছিলেন নতুন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান। কিন্তু আইয়ুবকে গদিচ্যুত করে যে সামরিক প্রধান ইয়াহিয়া ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তিনিই এ নির্বাচন দিয়েছিলেন। অথচ কত কি কপটতা। নির্বাচনে নিরংকুশ আওয়ামী-বিজয়কে মেনে নিতে পারল না পশ্চিমা কায়েমি স্বার্থবাদীরা। সেখান থেকে বাধল নতুন লড়াই। কারণ নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠদের টপকে ‘পাঞ্জাবি ক্লিক’কে তোয়াজ করতে গিয়ে ইয়াহিয়া এবং পাকিস্তান পিপল্স পার্টি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সমঝোতা হল। বাঙালির হাতে দেশশাসনের ভার দেয়া যাবে না। বিজয়ী আওয়ামী লীগকে বঞ্চিত করতে ঢাকায় ডাকা জাতীয় সংসদের অধিবেশন বাতিল করলে পূর্ববঙ্গ যেন অগ্নিগর্ভ রূপ ধারণ করল। এ তো সেই গণজাগরণেরই প্রতিফলন। মানুষ জাগছে নগরে বন্দরে, হাটবাজারে। শুরু হল অসহযোগ, ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অকুতোভয় বাংলার মানুষ ছুটছে মুক্তির সন্ধানে, মুখে তাদের প্রবল উচ্ছ্বাস ধ্বনি ‘জয় বাংলা’। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত দশদিক- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’
৭ মার্চ ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু ওই রেসকোর্স ময়দানের সুবিশাল গণজমায়েতে সব স্তরের মানুষকে জানিয়ে দিলেন ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’ এবং ‘বিপ্লবের রক্ত ঝাণ্ডা উড়ে আকাশে’।
এরই মধ্যে সামরিক শাসকচক্র ‘সংলাপ’-এর ফাঁদ পাতল। কিন্তু ব্যর্থ হলেন বাংলার সব মানুষের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী হামলে পড়ল বাংলার নিরীহ জনগণের ওপর। অসহযোগ আন্দোলনে যে মানুষ সংগঠিত হয়েছিল, তারা একই ফ্রন্টে এসে দাঁড়াল, সে ছিল মুক্তিফ্রন্ট। নির্বিচারে গণহত্যার বিরুদ্ধে নিরস্ত্র বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়াল মোকাবেলা ফ্রন্টে এবং সমুচিত শিক্ষা দিয়ে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে মুক্ত স্বদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি আমরা বাংলার আপামর জনগণ। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর দালাল ছিল কিছু অমানুষ, যারা হয়েছিল মানুষ হত্যার জল্লাদ আর কসাই। ওরাই হল হানাদারদের সহযোগী যুদ্ধাপরাধী জামায়াত, শিবির, রাজাকার, আল-বদর আল-শামস তথা রাজনৈতিক নয়, ধর্মব্যবসায়ী একটি চক্র। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতাকারী পরাশক্তি মার্কিনিরাও আমাদের গোটা উত্থানকে নিজ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার নানা কৌশল এঁটেই চলেছিল সেই মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই। আর দেশী অপশক্তি এবং বিদেশী পরাশক্তির হিংস্র যুগ্মতায় নবজাত বাংলাদেশকে পড়তে হল নতুন সংকটে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে বিভক্ত এবং নিশ্চিহ্ন করার মতলব আঁটল। কিন্তু মুক্তিসংগ্রামে প্রাণোৎসর্গকারী মানুষের এ অগণিত সংখ্যাকে নিশ্চিহ্ন করবে কি করে? তাই বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। ওঠেনি শুধু, আন্তর্জাতিক চক্রান্তে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ওই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দেশী-বিদেশী শক্তির দাপট শুরু হয়ে গিয়েছিল। আজও তা অব্যাহত। গোপন হত্যা, প্রকাশ্যে সন্ত্রাস করে নানা অপকৌশলে রাজনীতিকে কলুষিত করার মতলবে যেন মেতেছে।
আজ এমনই রাজনৈতিক উন্মাতাল পরিস্থিতিতে হে মহান নেতা, তোমাকে মনে পড়ছে। বিরোধী অপশক্তি আমাদের ধর্মান্ধ, মোহাবিষ্ট ও বিভ্রান্ত করতে চাইছে, কিন্তু বর্তমান গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ মহাজোট সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে তো আমরা ১৫ আগস্টের খুনিদের ক’জনকে শাস্তি দিয়েছি। কিন্তু আরও ক’জন পালিয়ে বেড়াচ্ছে বিদেশী মদদে, তাদেরও ধরতে তৎপর সরকার। শুধু তাই নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। হে বজ্রকণ্ঠ পুরুষ, তুমি যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছিলে, তা বন্ধ করে সবাইকে ছেড়ে দিয়েছিল জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার। কিন্তু আজ এদেশের সব মানুষের দাবি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং যথোপযুক্ত শাস্তি বিধানের। তখনই তোমায় মনে পড়ছে হে পরম বান্ধব বাঙালির, বঙ্গবন্ধু।
কামাল লোহানী : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী
পাকিস্তানি শাসক ও শোষকগোষ্ঠী যখন এই ভূ-খণ্ডের সব বাসিন্দাকে ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে পঙ্গু করতে মাতৃভাষা বাংলাকেই বিলুপ্ত করার অপকৌশল এঁটেছিল, সেদিন থেকেই যে প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংগ্রাম সূচিত হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ছুরিতে কেটে ভাগ করা বাংলার এই অংশে তখন তরুণ বয়স থেকে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম, তারপর একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। কারণ পাকিস্তান আন্দোলনে সোচ্চার বাঙালি এবং বাংলার উদার ও সচেতন মানুষের মোহ ভঙ্গ হতে বেশিদিন লাগেনি। যে প্রত্যাশায় বাংলার অমিততেজ মানুষ মুক্তি চেয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী পরাক্রমশালী শোষক শ্রেণীর হাত থেকে, তা পূরণ তো হয়ইনি, বরং ব্রিটিশ-বিতাড়িত বাংলার এই জমিনে ‘পাকিস্তান’ নামে একটি উদ্ভট দেশের পত্তন ঘটেছিল। তবে ভ্রান্তিবিলাসে বেশিদিন কাটাতে হয়নি আমাদের। আমরা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জানতে এবং বুঝতে পারলাম- কপট পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলার সখ্য সম্ভব নয় এবং বৈরী মানসিকতা তখন থেকে শুরু হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন তরুণ, তবু তেজ-তেজস্বীয়তায় ছিলেন অগ্রণী। বুঝতে পেরেছিলেন, এ রাষ্ট্রব্যবস্থার বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হতে না পারলে ধুঁকে ধুঁকে এ জাতিকে ধ্বংসই হতে হবে। সুতরাং অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই শুরু হয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র পত্তনের কাল থেকেই। ছাত্র-তরুণ বঙ্গবন্ধু তখন শেখ মুজিব, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সে তরুণ আপন নেতৃত্বগুণে চলে এলেন সামনে এবং গণতান্ত্রিক যুদ্ধের অধিনায়কত্ব গ্রহণে দ্বিধা করলেন না। শেখ মুজিব সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন, ব্রিটিশরা যে জিঞ্জির আমাদের হাতে-পায়ে পরিয়ে দিয়ে গেছে, তা থেকে মুক্ত হতে না পারলে জাতি হিসেবে টিকে থাকাই দায় হয়ে যাবে। তাই কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজজীবন থেকে যে পাঠ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেছিলেন, রাজনৈতিক জীবনের সূচনাতেই তার বৈভবে ৪৮-এই গ্রেফতার হয়ে গেলেন শেখ মুজিব। এদিকে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালেই শাসক মুসলিম লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে নতুন রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় ঘটেছিল- পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ সৃষ্টিতে। এ নতুন সংগঠনের প্রথম যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ মুজিব। ইতিহাস বলে, খন্দকার মুশতাক আহমদ সেদিনই মুজিব-বিরোধিতা করেছিলেন। কারণ মুশতাককে মওলানা সাহেব দ্বিতীয় যুগ্ম সচিব করেছিলেন। সেদিনের বিরোধিতায় কি আঁচ করা গিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর ‘হত্যাকারীর’ উদ্ভব ঘটে গেল? তারা ঘনিষ্ঠ ছিলেন দু’জনে কিন্তু জেলে আটক মুজিবকে কেন এক নম্বরে রাখবেন, এটাই ছিল খন্দকারের ক্ষোভ। সেই ক্ষোভ, হিংস্রতায় রূপ নিয়েছিল এবং ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটিয়েই সপরিবারে হত্যা করেছিল হন্তারকরা ১৯৭৫ সালে, ঠিক ২৬ বছর পরে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬-তে ৬ দফা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যেভাবে হন্যে হয়ে তাকে হেনস্থা করতে শুরু করল তাতে ফল হল উল্টো। পূর্ববঙ্গের রাজনীতিসচেতন মানুষ উপলব্ধি করলেন, শোষণ-বঞ্চনার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। সুতরাং আজ আর মাথানত করে নয়, বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর সময় উপস্থিত। দেশে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতা থেকে স্বকীয়তা অর্জনের পথে আন্দোলন ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সেই বিকল্পের নেতৃত্ব দিলেন সেই শেখ মুজিবই। তিনিই হলেন বঙ্গবন্ধু।
ছয়দফা কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলনই পূর্ববঙ্গবাসীকে দিয়েছিল সাহসে বুক বাঁধার শক্তি, আ্তপ্রত্যয়। তাই মানুষ ছুটল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, সংগঠিত হল। আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে দুঃশাসকের দল নির্যাতনে পোড় খাওয়া নেতায় পরিণত করল। জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠলেন তিনি। আইয়ুবি সামরিক শাসন জারি থাকলেও যেন মুজিব-নির্দেশেই দেশ চলবে, এমনই পূর্বাভাস মিলেছিল সেদিন। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সারা পাকিস্তানেই আওয়ামী লীগের জয়জয়কার। শেখ মুজিবই হবেন পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, এমন ঘোষণাই দিয়েছিলেন নতুন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান। কিন্তু আইয়ুবকে গদিচ্যুত করে যে সামরিক প্রধান ইয়াহিয়া ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তিনিই এ নির্বাচন দিয়েছিলেন। অথচ কত কি কপটতা। নির্বাচনে নিরংকুশ আওয়ামী-বিজয়কে মেনে নিতে পারল না পশ্চিমা কায়েমি স্বার্থবাদীরা। সেখান থেকে বাধল নতুন লড়াই। কারণ নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠদের টপকে ‘পাঞ্জাবি ক্লিক’কে তোয়াজ করতে গিয়ে ইয়াহিয়া এবং পাকিস্তান পিপল্স পার্টি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সমঝোতা হল। বাঙালির হাতে দেশশাসনের ভার দেয়া যাবে না। বিজয়ী আওয়ামী লীগকে বঞ্চিত করতে ঢাকায় ডাকা জাতীয় সংসদের অধিবেশন বাতিল করলে পূর্ববঙ্গ যেন অগ্নিগর্ভ রূপ ধারণ করল। এ তো সেই গণজাগরণেরই প্রতিফলন। মানুষ জাগছে নগরে বন্দরে, হাটবাজারে। শুরু হল অসহযোগ, ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অকুতোভয় বাংলার মানুষ ছুটছে মুক্তির সন্ধানে, মুখে তাদের প্রবল উচ্ছ্বাস ধ্বনি ‘জয় বাংলা’। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত দশদিক- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’
৭ মার্চ ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু ওই রেসকোর্স ময়দানের সুবিশাল গণজমায়েতে সব স্তরের মানুষকে জানিয়ে দিলেন ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’ এবং ‘বিপ্লবের রক্ত ঝাণ্ডা উড়ে আকাশে’।
এরই মধ্যে সামরিক শাসকচক্র ‘সংলাপ’-এর ফাঁদ পাতল। কিন্তু ব্যর্থ হলেন বাংলার সব মানুষের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী হামলে পড়ল বাংলার নিরীহ জনগণের ওপর। অসহযোগ আন্দোলনে যে মানুষ সংগঠিত হয়েছিল, তারা একই ফ্রন্টে এসে দাঁড়াল, সে ছিল মুক্তিফ্রন্ট। নির্বিচারে গণহত্যার বিরুদ্ধে নিরস্ত্র বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়াল মোকাবেলা ফ্রন্টে এবং সমুচিত শিক্ষা দিয়ে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে মুক্ত স্বদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি আমরা বাংলার আপামর জনগণ। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর দালাল ছিল কিছু অমানুষ, যারা হয়েছিল মানুষ হত্যার জল্লাদ আর কসাই। ওরাই হল হানাদারদের সহযোগী যুদ্ধাপরাধী জামায়াত, শিবির, রাজাকার, আল-বদর আল-শামস তথা রাজনৈতিক নয়, ধর্মব্যবসায়ী একটি চক্র। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতাকারী পরাশক্তি মার্কিনিরাও আমাদের গোটা উত্থানকে নিজ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার নানা কৌশল এঁটেই চলেছিল সেই মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই। আর দেশী অপশক্তি এবং বিদেশী পরাশক্তির হিংস্র যুগ্মতায় নবজাত বাংলাদেশকে পড়তে হল নতুন সংকটে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে বিভক্ত এবং নিশ্চিহ্ন করার মতলব আঁটল। কিন্তু মুক্তিসংগ্রামে প্রাণোৎসর্গকারী মানুষের এ অগণিত সংখ্যাকে নিশ্চিহ্ন করবে কি করে? তাই বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। ওঠেনি শুধু, আন্তর্জাতিক চক্রান্তে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ওই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দেশী-বিদেশী শক্তির দাপট শুরু হয়ে গিয়েছিল। আজও তা অব্যাহত। গোপন হত্যা, প্রকাশ্যে সন্ত্রাস করে নানা অপকৌশলে রাজনীতিকে কলুষিত করার মতলবে যেন মেতেছে।
আজ এমনই রাজনৈতিক উন্মাতাল পরিস্থিতিতে হে মহান নেতা, তোমাকে মনে পড়ছে। বিরোধী অপশক্তি আমাদের ধর্মান্ধ, মোহাবিষ্ট ও বিভ্রান্ত করতে চাইছে, কিন্তু বর্তমান গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ মহাজোট সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে তো আমরা ১৫ আগস্টের খুনিদের ক’জনকে শাস্তি দিয়েছি। কিন্তু আরও ক’জন পালিয়ে বেড়াচ্ছে বিদেশী মদদে, তাদেরও ধরতে তৎপর সরকার। শুধু তাই নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। হে বজ্রকণ্ঠ পুরুষ, তুমি যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছিলে, তা বন্ধ করে সবাইকে ছেড়ে দিয়েছিল জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার। কিন্তু আজ এদেশের সব মানুষের দাবি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং যথোপযুক্ত শাস্তি বিধানের। তখনই তোমায় মনে পড়ছে হে পরম বান্ধব বাঙালির, বঙ্গবন্ধু।
কামাল লোহানী : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী
No comments:
Post a Comment