Saturday 28 August 2010

রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিব ---- এইচ.টি. ইমাম

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন মাত্র ৪৪ মাসপাকিসত্মানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্ত হয়ে প্রথমে লন্ডন যানসেখান থেকে তিনি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদে প্রত্যক্ষভাবে আসীন হন ১২ জানুয়ারি তারিখেউলেস্নখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রম্নতি পেয়ে বঙ্গবন্ধুর সহকমর্ী তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ এবং এমসিএ-দের একত্রিত করে এক অধিবেশন ডাকেনঅধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় এবং ১০ এপ্রিল ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমনকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত হয় বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যনত্ম স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেনরাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর মুহূর্ত থেকে বঙ্গবন্ধু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিটি কাজে মনোযোগী হয়ে ওঠেন
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার দুই সপ্তাহ আগে মুজিবনগর সরকারের কয়েকজন কর্মকর্তাসহ আমি ঢাকায় সরকারী কাজকর্ম সচল করতে প্রয়াসী হই বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুগত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ দেয়া হয় এবং পাকিসত্মান সেনাবাহিনী কতর্ৃক বন্দী করে রাখা সরকারী কর্মকর্তাগণকে মুক্ত করে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে তাদের যথাস্থানে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল
প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগের কিছু কথা এখানে সংক্ষেপে উলেস্নখ করা প্রয়োজনপৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন দেশের অভু্যদয় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চবঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জনগণের নিরলস আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতেভয়াল পরিস্থিতির আশঙ্কা করে বঙ্গবন্ধু আগেই সহকমর্ীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে নিজে তাঁর বাসভবনে অবস্থান করছিলেনউন্মাদ পাকিসত্মান বাহিনীর কর্মকা ের পরিপ্রেক্ষিতে তকালীন ই.পি.আর.-এর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত বাণী সম্ভাব্য সব জায়গায় প্রেরণ করেছিলেন'ডিকোড মেসেজ' ২৬ মার্চ দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সব থানা ও ই.পি.আর. ক্যাম্পগুলোতে পেঁৗছে যায়শুরম্ন হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ এবং তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের মূল্যে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতা প্রিয় স্বাধীনতা!
সংসদীয় গণতন্ত্রে গভীরভাবে আস্থাশীল হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন ছিল স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতির প্রত্যাবর্তনব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি পেস্ননে তিনি বাংলাদেশের মাটিতে নামেনপ্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশে জাতির জনক প্রথমেই যে সিদ্ধানত্ম নিয়েছিলেন তাতে তাঁর প্রশাসনিক প্রজ্ঞা এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধার পরিচয় ফুটে ওঠেতিনি রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে দিয়ে জনগণের নিকট এবং সংসদে অধিকতর জবাবদিহিতামূলক প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ গ্রহণ করতে ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার সদস্যগণের সঙ্গে দু'দফা বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেনএ দু'টি বৈঠকে সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ সম্বন্ধে এবং ১৯৭২ সালের সাময়িক সংবিধান আদেশ জারির বিষয়ে সিদ্ধানত্ম গৃহীত হয়েছিল'রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধান আদেশ-১৯৭২' শীর্ষক আদেশে রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন, মন্ত্রিসভা নিয়োগ, শপথ, সুপ্রীমকোর্ট প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয় স্থান পেয়েছিল রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধান আদেশ জারির মধ্য দিয়ে সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এবং বিধিসম্মতভাবে পরিচালিত হওয়ার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়
রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রচলনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমকে সাময়িক সংবিধান আদেশ বলে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি সকালে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির মাধ্যমে শপথ গ্রহণ করে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তাঁর পদত্যাগ ঘোষণা করেনপদত্যাগ ঘোষণার পর রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধান আদেশের ৮ নম্বর ধারা বলে মন্ত্রিসভা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করেনপ্রধান বিচারপতি তাঁকে শপথবাক্য পাঠ করানএর পর সৈয়দ নজরম্নল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিসভার সব সদস্য পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধান আদেশের ৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়তখন বঙ্গবন্ধু ১১ সদস্য বিশিষ্ট এক মন্ত্রিসভা গঠন করেন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করানমন্ত্রিসভা পূর্ণাঙ্গ করতে বঙ্গবন্ধু আরও কয়েকজন যোগ্য, , প্রবীণ, বিশ্বসত্ম এবং জনগণের সেবায় যাঁরা শ্রেষ্ঠ তাঁদের নিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা ২৩ জনে উন্নীত করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ শক্তিশালী মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন এজন্য বঙ্গবন্ধুর কিছু সময় লেগে যায়প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাতে থাকে মন্ত্রিপরিষদ (ঈধনরহবঃ) ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যগণ ছিলেন সৈয়দ নজরম্নল ইসলাম (শিল্প মন্ত্রণালয়), তাজউদ্দীন আহমদ (অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়), খন্দকার মোশতাক আহমদ (বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়), ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী (যোগাযোগ মন্ত্রণালয়), আবদুস সামাদ আজাদ (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), এএইচএম কামারম্নজ্জামান (ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়), শেখ আবদুল আজিজ (কৃষি মন্ত্রণালয়), অধ্যাপক ইউসুফ আলী (শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়), জহুর আহমদ চৌধুরী (শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়), ফণীভূষণ মজুমদার (খাদ্য ও বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রণালয়), ডা. কামাল হোসেন (আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়), এম. আর. সিদ্দিকী (বাণিজ্য মন্ত্রণালয়), শামসুল হক (স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়), মতিউর রহমান (পূর্ত ও পৌর উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয়), আবদুল মালেক উকিল (স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়), মোলস্না জালাল উদ্দিন আহমদ (ডাক ও তার মন্ত্রণালয়), সোহরাব হোসেন (বন, স্য ও গবাদিপশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়), মিজানুর রহমান চৌধুরী (তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়), আবদুল মান্নান (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), আবদুর রব সেরনিয়াবত (ভূমি শাসন, ভূমি সংস্কার ও ভূমি রাজস্ব মন্ত্রণালয়, জেনারেল (অব) এমএ জি ওসমানী (জাহাজ, অভ্যনত্মরীণ নৌপরিবহন ও বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়) এবং ড. মফিজ চৌধুরী (বিদু্যত, প্রাকৃতিক সম্পদ ও কারিগরি গবেষণা মন্ত্রণালয়)
আগেই উলেস্নখ করা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেই যুদ্ধবিধ্বসত্ম বাংলাদেশ পুনর্গঠন এবং বাস্তুচু্যত মানুষের পুনর্বাসনের জন্য তাঁর প্রশাসনযন্ত্রকে সর্বাংশে সক্রিয় করা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের এ দুটি কাজে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছিলেনযুদ্ধবিধ্বসত্ম অর্থনীতি ও সমাজজীবনকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে যেতে মুক্তবুদ্ধি চরিত্রবান প্রগতিশীল শিক্ষিত সমাজের প্রয়োজনীয়তা জাতির জনক শুরম্নতেই উপলব্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু প্রধানত যেসব বিষয়ে অগ্রাধিকার প্রদান করেছিলেন তার মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন, সদ্য স্বাধীন দেশের প্রতি পৃথিবীর দেশসমূহের স্বীকৃতি আদায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তন, আধুনিক শিক্ষা-ব্যবস্থা চালুকরণ, আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী-ক্যাডারকে নৈরাজ্য ও হতাশামুক্ত করা, আধুনিক কৃষি উপাদন ব্যবস্থাসহ ভূমি সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছিলেনদারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পেঁৗছানোর বিষয়েও বঙ্গবন্ধু ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সততার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে একে একে স্বীকৃতি দিতে থাকে
ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভারতে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেনকারণ ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে আনত্মর্জাতিক অঙ্গনেও বিরূপ কথাবার্তা হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্যই ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতাবার্ষিকী উদ্যাপনের আগেই ভারতীয় বাহিনীর ফেরত-পর্ব সম্পন্ন হয়েছিলউলেস্নখ করা প্রয়োজন যে, ভুল বোঝাবুঝির কারণে গণচীন ১৯৭২ সালের ২৬ আগস্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের চেষ্টায় ভেটো প্রদান করেছিলএজন্য জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভে দু'বছর বিলম্ব ঘটেকিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রশাসনিক প্রচেষ্টায় ১৯৭২ সালের ১৮ আগস্ট কমনওয়েলথের সদস্যপদ অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠেয় ইসলামী সম্মেলনকে সামনে রেখে দাবি করেছিলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি পাকিসত্মান শর্তহীন স্বীকৃতি না দিলে ইসলামী সম্মেলনে তিনি যোগ দেবেন নাএ কারণে ইসলামী বিশ্বের চাপের মুখে বাধ্য হয় পাকিসত্মানের ভুট্টো সরকারতারা মেনে নেয় বাংলাদেশের বাসত্মবতাবঙ্গবন্ধুর প্রশাসনিক প্রজ্ঞার গভীর পরিচয়ও এতে পাওয়া গিয়েছিলগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জাতিসংঘ সদস্যপদ লাভের দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছিলসর্বপ্রথম ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণদান করেছিলেনপরবর্তীতে এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের মহান অমর একুশে আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদাও লাভ করেছেবাংলাদেশের মহান সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় ১৫৩ অনুচ্ছেদ সংযুক্ত হয়েছিলউক্ত অনুচ্ছেদে উলেস্নখ করা হয়েছে যে, "তবে শর্ত থাকে যে, বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাইবে।" উলেস্নখ্য, বাংলাদেশের সংবিধান বাংলায় প্রণীত, কিন্তু একটি ইংরেজী পাঠও রয়েছে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সরকার তথা প্রশাসন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে ভগ্নাবস্থা থেকে উদ্ধার করার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে দ্রম্নত দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা শুরম্ন করেবৈদেশিক সম্পদ আহরণে বঙ্গবন্ধুর প্রশাসন-ব্যবস্থা প্রাথমিক নীতি হিসেবে স্বল্পমেয়াদী উচ্চ সুদের ঋণ কম গ্রহণের ফলে বাংলাদেশের ঋণ সেবা অনুপাত (উবনঃ ঝবারপব জধঃরড়) এখনও দৃষ্টানত্ম হয়ে আছেবঙ্গবন্ধুর সরকার আমলে অনুসৃত এই নীতি আনত্মর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য বিরল খ্যাতি এনে দিয়েছিল
দেশের দ্রম্নত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং এর সুষম বণ্টন প্রধান বিষয় ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রশাসনের নিকটতাই বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটের শতকরা ৬০ ভাগ পলস্নী এলাকায় ব্যয় করার কথা ঘোষণা করেনবঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে নতুন করমুক্ত জাতীয় বাজেট ঘোষণা করতে অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেনঅভিজ্ঞ প্রশাসকের দৃষ্টিকোণ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন যে, দেশে বিরাজমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূরীকরণে অর্থনীতিবিদগণের সহায়তা দিতে এগিয়ে আসা প্রয়োজনএজন্য তিনি প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রফেসর নূরম্নল ইসলামকে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছিলেনএছাড়া অর্থনীতির প্রফেসর মোশাররফ হোসেন, প্রফেসর রেহমান সোবহান এবং প্রফেসর আনিসুর রহমানকেও প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য নিয়োগ করেছিলেনদেশের আরও কয়েকজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং আমলার পরিশ্রমে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১৯৭৩-৭৮ বঙ্গবন্ধুর সরকার অনুমোদন করেপরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব কমিশন কতর্ৃক প্রণীত দলিলের ভূমিকায় বলেছিলেন, 'হড় ঢ়ষধহ, যড়বিাব বিষষ ভড়সঁষধঃবফ, পধহ নব রসঢ়ষবসবহঃবফ ঁহষবংং ঃযবব রং ধ ঃড়ঃধষ পড়সসরঃসবহঃ ড়হ ঃযব ঢ়ধঃ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ঃযব পড়ঁহঃু ঃড় ড়িশ যধফ ধহফ সধশব হবপবংংধু ংধপরভরপবং. (কোন পরিকল্পনা তা যত ভালভাবেই প্রণীত হোক না কেন তা বাসত্মবায়ন সম্ভব হবে না যদি দেশের জনগণ তার জন্য প্রয়োজনীয় ত্যাগ স্বীকার না করে এবং কঠোর পরিশ্রমী না হয়)।"
দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু একথা ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুবিন্যসত্ম আর্থিক নীতিমালা এবং ব্যাংকিং খাতের সুষ্ঠু বিকাশ প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করেতাই, ব্যাংকিং সেক্টরে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা ছিল সুদূরপ্রসারীপাকিসত্মানীদের দীর্ঘ শোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন ধবংসযজ্ঞে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে নিপতিত হয়বিধ্বসত্ম অর্থনীতি, মুদ্রা ব্যবস্থার অভার ও ভগ্ন ব্যাংকিং ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তক্ষণা কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনর্গঠন করতে হয়স্বাধীনতার পর দেশে সাবেক পাকিসত্মানী মালিকানাধীন ব্যাংকসহ মোট তফসিলী ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ২২টি (মোট শাখা ১,১৯১টি) রাষ্ট্রীয় আদর্শের বাসত্মবায়নকল্পে ও প্রাপ্য সম্পদের সুষম বণ্টনের উদ্দেশ্যে ব্যাংকগুলোকে জাতীয়করণ করা জরম্নরী হয়ে পড়েব্যাংকিং খাত এবং ব্যাংক ব্যবসাকে পুনরম্নজ্জীবিত করার লক্ষ্যে কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক ও কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহে প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়আমানত বাড়ানো ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে অহেতুক প্রতিযোগিতা রোধকল্পে সূদের হার নতুনভাবে বিন্যসত্ম করা হয়অর্থনীতি পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক কার্যাবলী স্বাভাবিকীকরণের উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রসত্ম ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সম্পত্তির বিপরীতে ঋণ দেয়ার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অনুশাসন দেওয়া হয় (ব্যক্তিপ্রতি সর্বোচ্চ পঁচিশ হাজার টাকা হারে)ভগ্নপ্রায় অর্থনীতিকে পুনরম্নজ্জীবনের লক্ষ্যে প্রবাসী বাঙালীরা যাতে দেশে টাকা পাঠাতে উসাহী হয় সে লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে একটি প্রিমিয়াম স্কিম গ্রহণ করা হয়, যেখানে প্রতি পাউন্ডের বিপরীতে ৩০ (ত্রিশ) টাকা করে দেয়া হতো (মুদ্রার তকালীন মূল্যহার ছিল ১ পাউন্ড= ১৮.৯৬ টাকা)ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সব রেগুলেটরি পদক্ষেপ নেয়া হয় তা বেশ ফলপ্রসূ হয়েছিলতফসিলী ব্যাংকগুলোর ১৯৭২ সালের জুন মাসের আমানত ছিল ৫২৩.৬১ কোটি টাকা, যা ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ৯৯৪.৫৮ কোটি টাকায় উন্নীত হয়
প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটির প্রয়োজনীয়তা বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও মননে এমনভাবে প্রোথিত ছিল যে, যার জন্য তিনি তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের মাত্র ছয় মাসের
মাথায় ১৯৭২ সালের ১৪ জুলাই ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি জাতীয় বেতন কমিশন গঠন করেছিলেনএই কমিটির সদস্যগণ বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে শতাধিক বৈঠক করেছিলেনতারা পৃথিবীর কয়েকটি দেশের সরকারী কর্মচারীদের জন্য বেতন-ভাতা সুবিধাদি পর্যালোচনা করে বাংলাদেশে বিদ্যমান পাকিসত্মানী আমলের
২২৫০টি বেতন স্কেল সমন্বিত ও একীভূত করে মাত্র দশটি স্কেলে আনার সুপারিশ করেছিলেনএই কমিটির সুপারিশ ও সিদ্ধানত্ম অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছিলেনএতে সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে বেতন স্কেল নিয়ে ধুমায়িত ক্ষোভ হতাশা বহুলাংশে দূরীভূত হয়েছিল
ব্রিটিশ আমলের শিক্ষাব্যবস্থায় যুগোপযোগী পরিবর্তন আনয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রশাসনকে পরামর্শ দেনতাঁর ঐকানত্মিক আগ্রহে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিলএই কমিশন বিগত ১৯৭৪ সালের ২৪ মে এক যুগানত্মকারী প্রতিবেদন পেশ করেপ্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে খুদা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, "সমগ্র দেশে সরকারী ব্যয়ে ১ম থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যনত্ম বিজ্ঞানসম্মত মৌলিক পাঠ্যসূচীভিত্তিক এক ও অভিন্ন মানের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করতে হবেএকই মৌলিক কাঠামোর মধ্যে সমাজ জীবনের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্নতার সুযোগ থাকতে পারেশিক্ষার মাধ্যমিক সত্মরের শিক্ষাথর্ীদের মেধা ও প্রবণতা অনুসারে গড়ে তোলার কথা উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়নবম ও দ্বাদশ শ্রেণী পর্যনত্ম চার বছরের শিক্ষাক্রম-ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়দেশের মানব সম্পদের চাহিদা অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার সীমিত সুযোগ সদ্ব্যবহারের সুপারিশ প্রতিবেদনে ছিলবঙ্গবন্ধুর
দিকনির্দেশনার আলোকে প্রণীত কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের সুপারিশমালা বিগত
চারদলীয় জোট সরকার এবং সাবেক এরশাদ সরকার গুরম্নত্ব না দিলেও বর্তমান
গণতান্ত্রিক মহাজোট সরকার স্বাধীন দেশের মর্যাদা এবং প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সঙ্গতি
রেখে এই প্রতিবেদনের অধিকাংশ সুপারিশ বাসত্মবায়নে ব্রতী হয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেবঙ্গবন্ধুর আরও কয়েকটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ যুগানত্মকারী ছিল এগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৬০ বাতিল করে ছাত্র-শিক্ষকদের অনুকূল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট ১৯৭৩ প্রচলন, রাষ্ট্রপতির ১০
নম্বর অধ্যাদেশ-১৯৭৪ অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-র নির্বাচন ১৯৭২ সালের মে মাসে সম্পন্নকরণ, কৃষি বিপস্নব ও ভূমি ব্যবস্থাপনায় ব্যতিক্রমধমর্ী সংস্কার আনয়নের
জন্য ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ ঢাকার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে তাঁর দ্বিতীয় বিপস্নবের কর্মসূচী ঘোষণা ইত্যাদি প্রধানতম ছিল
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রশাসনিক কর্মকা ের বিসত্মৃত বিবরণ এই স্বল্প পরিসরে দেয়া সম্ভব নয়সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বসত্ম বাংলাদেশের সমস্যার সীমা-পরিসীমা নিরূপণ করা ছিল দুঃসাধ্যতবে তকালে বিদেশী গণমাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যমান দুঃখ-দুর্দশার কথা ফলাও করে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে ভারতের সীমানত্ম এলাকা থেকে ফিরে আসা বাস্তুচু্যত শরণাথর্ীদের পুনর্বাসন সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিলখাদ্যাভাব ছিল সর্বত্রবাংলাদেশের প্রশাসনের পুলিশ বাহিনীকে বিধ্বসত্ম করে দিয়েছিল পাকিসত্মানী বাহিনী পাকিসত্মানী হানাদাররা তকালীন পূর্ববঙ্গের রাসত্মাঘাট, পুল-কালভার্ট, সেতু, ঘরবাড়ি, বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছিলএসব পুনর্নির্মাণের কাজ সহজসাধ্য ছিল নাআইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দারম্নণ অবনতি ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়, আবার শত্রম্নমুক্ত হওয়ার পর স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের অপতপরতা, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর কমর্ী হত্যা, থানা লুট, পাটের গুদামে আগুন, গুপ্ত হত্যা, ডাকাতি, লুটপাট, কালোবাজারি, মজুদদারি শুরম্ন হয়ে যায়শুরম্ন হয় দেশের বিরম্নদ্ধে আনত্মর্জাতিক ও দেশীয় চক্রানত্মদেশের অভ্যনত্মরে নকশাল, সর্বহারা, আবদুল হক প্রভৃতি বাহিনীর অত্যাচার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেআত্রাই, নাটোর, খুলনা ইত্যাদি অঞ্চলেও দেখা দেয় মারাত্মক সব বাহিনীর অনত্মর্ঘাতমূলক তপরতাএমন আরও শত শত সমস্যা বঙ্গবন্ধু সব মোকাবেলা করেছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতায়, যা ছিল প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্যেম-িতবঙ্গবন্ধু কীভাবে পর্বতপ্রমাণ সমস্যা মোকাবেলা করেছিলেন, সে কথা মনে করলে শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে যায়স্বাধীন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু

No comments:

Post a Comment

Photographs, Audio, Video and Text on Bangabandhu  ***Please use Vrinda Font if there is a problem to read Bangla ***       Click o...