Saturday 28 August 2010

বাঙালীর মানস নায়ক ----- মনি হায়দার

দেশকে ভালোবেসে, দেশের সাধারণ দরিদ্র মানুষের জন্য তিনি আজীবন লড়াই করেছেন। একমাত্র তিনিই বলতে পারতেন_ আমার দেশ, আমার মানুষ। পৃথিবীর যে রাষ্ট্রেই তিনি থাকতেন তাঁর চৈতন্যের ভেতরে সব সময় থাকতো বাংলাদেশ, বাংলাদেশের দুঃখ তাড়িত মানুষের মুখচ্ছবি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানী বর্বর জান্তা শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রত্যন্ত এলাকা লায়ালপুরের কারাগারে বন্দি করে রাখে। তাঁর নির্জন সেলের সামনে কবর খুঁড়ে শেখ মুজিবকে ভয় পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অসম সাহসী বাঙালী নেতা শেখ মুজিব ভয় পাননি, বরং পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে বলেছে, "আমি বাঙালী, আমি মুসলমান, আমি মানুষ। মানুষ একবারই মরে বারবার মরে না। আমি কখনই আত্মসমর্পণ করবো না। যদি তোমরা আমাকে মেরে ফেলো মৃতু্যর পর আমার লাশটা আমার দেশে আমার মানুষদের পেঁৗছাইয়া দিও।"
এমন করে বাঙালীর তরে আর কেউ কি কোন দিন_নিজেকে উৎসর্গ করবে?
খা-দাহন আর রক্তগঙ্গার স্রোতের ধারায় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি পাকিসত্মানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে আসেন তাঁর চিরকালের আরদ্ধ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম' _ সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন-'রবীন্দ্রনাথ আজ আপনি দেখে যান, বাঙালী আজ মানুষ হয়েছে।' হঁ্যা, বিশ্বকবি রবীন্দনাথ ঠাকুরকে স্পর্ধার সঙ্গে এ কথা বলার সাহস ও যোগ্যতা রাখতেন একমাত্র শেখ মুজিব।
শত সহস্র বছরের ইতিহাসে একমাত্র শেখ মুজিবই 'আমার দেশ-আমার মানুষ' বলার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। এবং এটা অর্জন করেছিলেন তাঁর দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি শর্তহীন ভালোবাসা আর অসামান্য ত্যাগের ভেতর দিয়ে। তিনিই একমাত্র বাঙালী যিনি তাঁর যৌবনের অধিকাংশ সময় পাকিস্তানী শাসকদের সীমাহীন শোষণের বিরম্নদ্ধে লড়াই করে পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগারে কাটিয়েছেন। এমনকি তাঁর বড় মেয়ে শেখ হাসিনার যখন বিয়ে হয় তখনও তিনি কারাগারে। সদ্য বিবাহিত শেখ হাসিনা এবং জামাতা পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ কারাগারে গিয়ে শেখ মুজিবের আশীর্বাদ নিয়ে এসেছিলেন। এমন রাজনৈতিক ত্যাগী নেতা ক'জন আছে পৃথিবীর ইতিহাসে?
পাকিসত্মানের করালগ্রাস থেকে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সুযোগ্য নেতৃত্ব বাংলাদেশ স্বাধীন হলে গোটা পাকিসত্মানের নিকৃষ্ট রাজনীতিবিদ মি. জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন পাকিসত্মানের প্রেসিডেন্ট বনে যান। উপায়হীন হয়ে সে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। লায়ালপুর কারাগার থেকে একটি সুরক্ষিত বাড়িতে এনে শেখ মুজিবের মুখোমুখি বসে ভুট্টো আবদার তোলে_'আপনি মুক্ত, কিছুক্ষণ পরই আপনাকে বিমানে তুলে দেয়া হবে। একজন মুক্ত নাগরিক হিসেবে আপনি পৃথিবীর যেখানে ইচ্ছা যাবেন। তবে যা হওয়ার হয়েছে, এখনও কি একটা সম্পর্ক রাখা যায় না, নিদেনপক্ষে দুটি দেশের পক্ষে একটা কনফেডারেশন?
শেখ মুজিব তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে পাইপে অগি্নসংযোগ করতে করতে বললেন 'আজ দীর্ঘ নয় মাস আমি আমার মানুষ থেকে, দেশ থেকে দূরে। আগে আমি আমার দেশে_আমার মানুষের কাছে যাবো। তাদের সঙ্গে কোনো কথা না বলে আমি সিদ্ধানত্ম নিতে পারি না।' এখানেই শেখ মুজিব বাংলাদেশ আর বাঙালী এক, একাকার এবং অভিন্ন। শেখ মুজিবের জীবন একটি বর্ণাঢ্য মহাকাব্য। এ কাব্যে যেমন রয়েছে সাহসের উপমা, সংগ্রামের ঘনঘটা, বিদ্রোহের উদাহরণ, দ্বন্দ্ব ও বিক্ষোভ, তেমন রয়েছে বির্নিমাণের ইতিহাস। সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে তাঁকে নিয়ে যত গল্প কবিতা প্রবন্ধ রচনা করা হয়েছে আর কোনো রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে হয়নি। হওয়ার সম্ভবনাও নেই। কারণ তিনি কেবল বাংলার ও বাঙালীর নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরম্নদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তাঁর বন্ধু ছিলেন কিউবার বিপস্নবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো, ফিলিসত্মিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত, জাম্বিয়ার নেতা কেনেথ কাউন্ডা, যুগোসস্নাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর বন্ধুদের তালিকা দেখেই বোঝা যায় তাঁর মানসিকতা, তাঁর রাজনৈতিক অঙ্গন, তাঁর আগ্রহের কেন্দবিন্দু।
শেখ মুজিবের হৃদয় ছিল বাংলার আকাশের মতো বিশাল। তিনি খুব সহজেই যে কোনো অপরাধে ক্ষমা করে দিতে পারতেন। কিন্তু শংকর জাতের বাঙালী জাতি অসম্ভব অকৃতজ্ঞ আর ষড়যন্ত্রকারী। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রানত্মরে মীরজাফরের কাছ থেকে যা পেয়েছে উত্তরাধিকার গর্বিত মালিকানায়। তারা ক্ষমার সৌন্দর্যকে ভোগ করতে জানে না, জানতো না। তারা ক্ষমতার মোহে ধমর্ীয় উন্মাদনায় এতটা পাশবিক মানসিকতার পূর্ণ যে, আপন স্বার্থের জন্য পিতাকেও খুন করতে পারে। তারই আশ্চর্য উদাহরণ সপরিবারে শেখ মুজিবের নির্মম হত্যাকা-। তাঁর অপরূপ ক্ষমাময় বৈশিষ্ট্যই তাঁকে নৃশংসভাবে- সপরিবারে হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল পাষ- মুষিক ভীরম্ন হত্যাকারীদের। ওরা রাতের অন্ধকারে ঘুমনত্ম অস্ত্রহীন শানত্ম নর-নারীর ওপর বুলেট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আর কি অবাক কা-- রাষ্ট্র পিতার হত্যাকারীরা পায় পুরস্কার রাষ্ট্র থেকে। কোন রাষ্ট্র থেকে? যে রাষ্ট্র শেখ মুজিব নিজেই তৈরি করেছিলেন। সম্ভবত পৃথিবীর কোনো দেশে এমন নজির নেই। ভবিষতেও হবে না।
শেখ মুজিব ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে একজন সফল কূটনীতিক, রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর সফল ও আনত্মরিক চিনত্মা ও বাসত্মববোধের কারণে স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যে পৃথিবীর অধিকাংশ স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন। জাতিসংঘের সদস্য হওয়া, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য হওয়া, ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্যভুক্ত হওয়া_ সবই ছিল তাঁর সময়ের উলেস্নখযোগ্য সাফল্য। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যতম কর্মকর্তা ফারম্নক চৌধুরী। তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক লিখেছেন। জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক অজানা ঘটনা। পাঠকদের সঙ্গে সেসব সাহসী এবং ইতিহাসের অমর স্মৃতিভা-ার থেকে একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। কেন ধরছি?
এদেশের মানুষ ধর্মে মুসলমান। ইসলাম ধর্ম অবলম্বনকারী মুসলমানেরা পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মতো গল্পে বিশ্বাস করে। ধর্ম মানেই অবিশ্বাস্য গল্পের ডালপালা। কিন্তু সত্য দেখলে গল্প ও গল্পবাজরা ভয় পায়। শেখ মুজিব বা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে অনেক মিথ্যা গল্প বানানো হয়েছে এবং বানিয়েছে ধর্ম ব্যবসায়ীরা। ফারম্নক চৌধুরীর এই স্মৃতিচারণ এদেশের অনেকেই পাঠ করেননি। পাঠ করলে শেখ মুজিব বা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক ধারণার ইতি ঘটতো এবং তাকে নিয়ে গর্বে আনন্দে বুক ফুলে উঠতো। সে কারণে এই অধ্যায়টি বড় হলেও উপস্থাপন করলাম_
"এখনো মানস চোখে কখনো ভেসে আসে নয়াদিলিস্নর শীতের কুয়াশা ঢাকা আকাশ ভেদ করে বঙ্গবন্ধুর রম্নপালি কমেট বিমানটির অকস্মাৎ আবির্ভাব আর অবতরণ। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এর সেই অবিশ্বাস্য সকাল। পালাম বিমানবন্দর। আটটা বেজে দশ মিনিট। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রম্নপালি কমেট বিমান ধীরে ধীরে এসে সশব্দে সুস্থির। তারপর শব্দহীন কর্ণভেদী নীরবতা। সিঁড়ি লাগল। খুলে গেল দ্বার। দাঁড়িয়ে সহাস্য, সুদর্শন, দীর্ঘকায়, ঋজু, নবীন দেশের রাষ্ট্রপতি। অকস্মাৎ এক নির্বাক জনতার ভাষাহীন জোয়ারের মুখোমুখি। সুইচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন তিনি আবেগের বাঁধভাঙ্গা দুটি শব্দ_ 'জয় বাংলা'। করতালি, উলস্নাস, আলিঙ্গন। তারপর আবেগের অশ্রম্নতে ঝাপসা স্মৃতি।
সেই দিন বিমানবন্দরের হাজারো গণ্যমান্য মানুষের ভিড়েও স্মৃতিপটে শুধু ভেসে আসে গাঢ় ধূসর বর্ণের গলাবন্ধ সুট আর কালো ওভারকোট পরিহিত নবীন দেশের এই রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি। শীতের হওয়ায় অসংখ্য সমা্ভষণ আর আলিঙ্গনে তার ঘনকালো চুলও কিছুটা অবিন্যসত্ম। স্বাধীনতা-উত্তর অভিজ্ঞতায় এই প্রথমবারের মতো দিলিস্নর আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হলো আমাদের রাষ্ট্রপতির সম্মানে একুশটি তোপধ্বনি। তারপর বঙ্গবন্ধুর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন। তারপর ব্রাসব্যান্ডে 'আমার সোনার বাংলা' আর 'জনগণ মন' দুটি দেশকে উপহার দেয়া বাংলার এক অমর কবির দুটি গানের রেশ সুমধুর। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিক ভাষণে তিনি ভারত এবং ভরতবাসীকে ধন্যবাদ জানালেন_ 'আমার এই যাত্রা বাসত্মবায়নের প্রচেষ্টায় আপনারা অক্লানত্ম পরিশ্রম করেছেন, করেছেন বীরোচিত আত্মত্যাগ।' তিনি স্মরণ করলেন তাঁর দেশবাসীকে_ 'আমার মানুষের কাছ থেকে যখন আমাকে ছিনিয়ে নেয়া হলো, তারা তখন কেঁদেছিল। আমি যখন কারাগারে, তারা চালিয়েছিল সংগ্রাম, আর আজ আমি যখন ফিরছি, তখন তারা বিজয়ী।' অনতিদূরে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তে দেখেছিলাম তার অশ্রম্নসিক্ত চোখ। সেই অশ্রম্ন ছিল ভালোবাসা, গর্ব আর আনন্দের। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতার পর শীতের সেই প্রতু্যষের জনসভাও ছিল এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বিমানবন্দর থেকে মোটর মিছিলে সভাস্থলে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। প্রথমে হিন্দিতে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর পকেটে রয়েছে জনসভার জন্য প্রণীত একটি ইংরেজি ভাষণ। ভাষণটি তার পকেটেই রয়ে গেল। তিনি বাংলায় করলেন তার ভাষণের শুরম্ন_ 'শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, উপস্থিত ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ....' তাঁর কথা শেষ না হতেই করতালি, তারপর তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি লাইনের সঙ্গে সঙ্গে করতালি। জনসভায় বসে আমার মনে হয়েছিল, এটি যেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর করতালির দ্বৈতসঙ্গীত। বক্তৃতা শেষে আবার মোটর মিছিলে জনসমুদ্র ভেদ করে পুষ্পতোরণ সজ্জিত রাজপথে আমরা গেলাম নয়াদিলিস্নর রাষ্ট্রপতি ভবনে।
সেই সকালে আমার প্রধান দায়িত্ব বাংলাদেশের প্রটোকল প্রধানের। আমার পাশে, সেই উত্তেজনাময় মুহূর্তগুলোতে, সর্বাঙ্গীণ সহায়তায় ছিলেন ভারতের প্রটোকল প্রধান মাহবুব খান। তিনিই আমাকে পালাম বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর বিমান অবতরণের পূর্বক্ষণে অবহিত করলেন আমাদের নির্ধারিত যাত্রাসূচি। দিলিস্ন থেকে আমরা সেই সকালেই যাবো কোলকাতা। কোলকাতায় বঙ্গবন্ধু অপরাহ্নে একটি জনসভায় ভাষণ রাখবেন। তারপর কোলকাতা থেকে ঢাকা, যেখানে সেই অপরাহ্নেই অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জনসভা। মাহবুব খান বললেন দিলিস্ন থেকে আমরা সফর কারবো ব্রিটিশ কমেটে নয়, ভারতের রাষ্ট্রপতির সরকারী বিমান 'রাজহংসে'। লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর বিমান অবতরণের আগেই আমাদের মালামাল 'রাজহংস'এ রাখা হল। মাহবুব খান জানালেন যে, বঙ্গবন্ধু আর তাঁর সহগামীদের মালামাল রাজহংসে স্থানানত্মরিত করা হবে। বললেন সেই দায়িত্বটি হবে তারই।
জনসভার পরপরই রাষ্ট্রপতি ভবনে বঙ্গবন্ধু আর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একানত্ম বৈঠকে মিলিত হলেন। আমরা, পাত্রমিত্ররা, একটি পাশের সুসজ্জিত হল কামরায় উর্দিপরা রূপোর ট্রেধারী বেয়ারাকুল দ্বারা গরম গরম সামোশা, কাবাব আর ধূমায়িত চা কফিতে আপ্যায়িত হচ্ছি। হঠাৎ আমার সহকর্মী মাহবুব খানের তলব পড়লো সেই কামরায় যেখানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আর বঙ্গবন্ধুর একানত্ম বৈঠক চলছে। কিছুক্ষণ পরই ব্যসত্ম সমসত্মভাবে বেরিয়ে এলেন মাহবুব খান। বললেন, 'প্রিয় সহকমর্ী আমার! সফরসূচি পালটে গেছে। সব কিছু পালটে গেছে। আপনারা আর কোলকাতা যাচ্ছেন না। এখান থেকে সোজা ঢাকা। আর তাও আবার রাজহংসে নয়; ব্রিটিশ কমেটে। তারপর বললেন, আমার তাতে চিনত্মিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি এখনই বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমাদের মালামাল 'রাজহংস' থেকে আবার কমেটে রেখে দিতে আর ঢাকা ও কোলতাকায় তিনি সেই মর্মে এখুনি করবেন বার্তা প্রেরণ। আমার শুধু একটি দায়িত্বই রয়েছে। দিলিস্নতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার টেরেন্স গারভির সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে নিশ্চিতভাবে অবগত হওয়া যে, কমেট বিমানটি যুদ্ধবিধ্বসত্ম ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়েতে অবতরণ করতে সক্ষম হবে কি-না। তার সূত্র থেকে তিনি জেনেছেন যে তা সম্ভব; তবুও সাবধানের মার নেই। আমারই তা সরাসরি জেনে নেয়া উচিত হবে। ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার টেরেন্স গারভির সঙ্গে ছিল আমার বহুদিনের পরিচয়। ষাটের দশকের শুরম্নতে তিনি যখন বেইজিংয়ে ব্রিটিশ দূতাবাসের কাউন্সিলর, আমি তখন সেখানে পাকিসত্মান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব। ৬ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের মাঝে আমার নাম খবরের কাগজে দেখে তিনি আশোক হোটেলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। যদিও ব্রিটেন তখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, যদিও বঙ্গবন্ধুর আশু মুক্তি সম্বন্ধে ৭ ডিসেম্বর আমাদের কোন ধারণাই ছিল না, টেরেন্স গারভি আমার সঙ্গে সেদিন আমার কামরায় দেখা করতে এসেছিলেন; আলোচনা করেছিলেন বাংলাদেশের যুদ্ধ-উত্তর অবস্থা। মাহবুব খানের অনুরোধে তাৎক্ষণিকভাবেই আমি স্যার টেরেন্স গারভির সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ স্থাপন করলাম। তিনি আমাকে নিশ্চয়তা প্রদান করলেন যে, ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়েতে কমেট বিমানটির সম্পূর্ণ নিরাপদ অবতরণ সম্ভব। পেস্ননে বঙ্গবন্ধুর মুখেই শুনছিলাম বদলের কারণগুলো। শুনলাম কোলকাতা যাত্রার সূচি পরিবর্তনের কারণ ছিল তিনটি। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছে প্রথম সুযোগেই তার দেশের মানুষের কাছে ফিরে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কারণে কোলকাতায় বিলম্ব ঘটে, শীতের সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যায় ঢাকায় জনসভা অনুষ্ঠিত করা, ঢাকার বিদু্যৎ সরবারহের অনিশ্চয়তায় হয়তো অসম্ভব হতো। তৃতীয়ত, স্বাধীনতা সংগ্রামে পশ্চিমবঙ্গ আর কোলকাতার অধিবাসীরা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে দিয়েছে আশ্রয়। তাদের ঢাকার যাত্রা পথের বিরতিতে ধন্যবাদ না জানিয়ে, বঙ্গবন্ধুর মতে, যথার্থ হবে না, তাই একটি বিশেষ সফরে কোলকাতা গিয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা।
আর দিলিস্ন-ঢাকার এই যাত্রা, ভারতের রাষ্ট্রপতির বিমান, 'রাজহংস' নয় কেন?
বঙ্গবন্ধুর কথায়_ ব্রিটিশ সরকার বিশেষ সৌজন্যমূলক ব্যবস্থায় যে বিমানটি দিয়েছেন, মাঝপথে অকারণে তা বদল করা সমীচীন হতো না মোটেও।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকা প্রত্যাবর্তনের সেই প্রসন্ন অপরাহ্নে বাংলাদেশের প্রটোকল প্রধান হিসেবে অনুধাবন করেছিলাম যে, আমাদের নবীন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে কূটনীতি আর কূটনৈতিক আচরণে দীক্ষা লাভের আমার রয়েছে যথেষ্ট অবকাশ। তার পরের স্মরণীয় দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর সানি্নধ্যে, তার প্রমাণ পেয়েছিলাম আরো। ''শেখ মুজিব এইভাবে বাংলাদেশকে তাঁর সমগ্র সত্তায় ধারণ করেছিলেন। তিনি বাংলা ও বাঙালীর স্বাধীন সত্তা আবিষ্কারের স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর স্বপ্ন মানেই বাংলা ও বাঙালী। তিনি কেবল সৃজন করেছিলেন, কিন্তু মানসপটে অাঁকা রূপটি দিয়ে যেতে পারেননি। আমরাও পারিনি। কারণ_ সেই ফাঁকিসত্মান, আর ফাঁকিসত্মানের ভূত। সেই ভূত আমাদের এখনও তাড়া করে ফেরে। আমিতো মাঝে মাঝে শিউরে উঠি_যদি কোনো কারণে একাত্তর সালে বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো_ কি হতো আমাদের পরিণতি? ওরা নয় মাসে এদেশের রাজনৈতিক দোসরদের সহায়তায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছিল, দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম লুণ্ঠন করেছিল। হাজার হাজার ঘরবাড়ি_ বাজার হাট আগুনে পুড়িয়েছিল। সেই নরাধমদেরই পদ লেহন করতে হতো আমাদের। টেলিভিশনের ডিজি থাকতো একজন উর্দুভাষী পাঞ্জাবী। বেতারের ডিজি থাকতো আরও একজন পাঞ্জাবী। শিল্পকলার ডিজি হতো একজন জেনারেল, যার হাতে শিল্পকলার পরিবর্তে থাকতো ডা-া। বাংলা একাডেমী হয়ে যেত উদর্ু চর্চ্া ও গবেষণার আখড়া। পশ্চিমাদের সঙ্গে জুটে যেত কিছু পা-চাটা বাঙালী। সরকারের অধিকাংশ ভালো মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিব থাকতো প্রায় পনেরো শ' কিলোমিটার দূরের বিজাতীয় ভাষার হীন-মানসিকতার মুখোশধারী মানুষগুলো। তাদের কথায়_ তাদের আদেশে, আমাদের ভারবাহী বলদের মতো চলতে হতো কেননা_ তারা বন্দুকের নল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আর সেনাবাহিনীর কথা নাই বললাম। তার প্রমাণ পাকিসত্মানীরা তাদের চবি্বশ বছরের শাসনে রেখেছিল। এতোসব অবদমন অপমান আর অধোগমনের প্রতিশোধ স্পৃহায় শেখ মুজিব ছিলেন আমাদের আশার শেষ সাম্পান। শেখ মুজিব নামে লড়াকু এবং বিচক্ষণ, আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন দরদী একজন নেতা আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু, হায় তাকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। আমরা তাঁকে হত্যা করেছি। হত্যা করে উলস্নাস করেছি। তারপর আমরা জলপাই রঙের জেনারেলদের বুটের তলায়_ আমাদের সাহসকে বিসর্জন দিয়েছিলাম। দীর্ঘ সময় পার হয়ে এখন সময় এসেছে_ আত্মআবিষ্কারের। তাই_একজন মানুষ, একজন শেখ মুজিব, একজন শেখ সাহেব, একজন মজিবর, টুঙ্গিপাড়ার একজন খোকা_ এভাবেই ইতিহাস নির্মাণ করে, ইতিহাসেরই গহীন অংশ হয়ে যান। তাঁকে ছাড়া বাংলার ইতিহাস অচল। আর সে কারণেই আমরা_ তাঁরই নির্মিত এই সুজলা সুফলা শ্যামল বাংলায় স্থির প্রতিজ্ঞাব্ধ হয়ে তাঁরই চৈতন্যের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মানত্মরে।

No comments:

Post a Comment

Photographs, Audio, Video and Text on Bangabandhu  ***Please use Vrinda Font if there is a problem to read Bangla ***       Click o...