সুনামি বা ভূমিকম্পের মতো মাত্র ২০ মিনিটের একটা বক্তৃতা একটি জাতির ইতিহাসের দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে_ এটা ভাবতেও বিস্ময়বোধ হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। সেদিনের রেসকোর্স ময়দানের উত্তাল জনসমুদ্র। অপেক্ষমান জনতার কাছে প্রতিটি মিনিট যেন এক একটা শতাব্দী। অপরাহ্ন ৩টা ১৫ মিনিটে মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন তিনি। সমুদ্রগর্জনে মুখর জনসমুদ্র 'জয় বাংলা_ জয় বঙ্গবন্ধু' ধ্বনিতে চরাচর প্রকম্পিত করছে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি এবং কালো মুজিবকোট পরিহিত দীর্ঘদেহী শ্যামকান্ত মানুষটি মঞ্চের সামনে, ডানে, বামে_ চারদিকে জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে তাদের অভিনন্দনের জবাব দেন। তারপর ঠিক বেলা ৩টা ২০ মিনিটে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে জলদগম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, "ভায়েরা আমারঃ।"
পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে আসে। আবেগের তন্ত্রীতে যেখানে ঝঙ্কার তোলে, সেখানেই সমুদ্রগর্জনে গগনবিদারী শেস্নাগান ওঠে। মাত্র ২০ মিনিটের ভাষণ শেষ হয় এই কথা বলে, 'ঃএবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।' ব্যস, এটুকুই। ওই বিশ মিনিটেই নির্ধারিত হয়ে যায় বাংলাদেশের ভাগ্য এবং সংগ্রামের চরিত্র ও লক্ষ্য। আর ওই ২০ মিনিটের বক্তৃতায়ই বাংলাদেশের মানুষ পেয়ে যায় ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশনা।
মাত্র ওই ২০ মিনিটের বক্তৃতায় বাঙালি জাতির হাজার বছরের প্রতীক্ষার পালা শেষ হয়ে যায়। তারা জেনে যায় তাদের লক্ষ্য কী, তাদের কী করতে হবে। "আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন আরও রক্ত দেব- কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।" অথবা তার আগের উচ্চারণ, "আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।" কী ছিল না ওই বক্তৃতায়? যেসব মতলববাজ অথবা জ্ঞানপাপীরা ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে খাটো করতে চান অথবা তাকে অস্বীকার করতে চান তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। ওরা পাকিস্তান ভাঙার যন্ত্রণাটার কিছুটা উপশমের জন্য ইতিহাসের এক খলনায়ককে বঙ্গবন্ধুর স্থলাভিষিক্ত করতে গিয়ে নিজেরাই উপহাসের পাত্র হয়ে গেছেন। কিন্তু আরও কিছু 'মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের' কলম বিপস্নবী আছেন, যারা বলতে চান, 'স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের জন্য শেখ মুজিবের কোন প্রস্তুতি ছিল না। তিনি জনগণকে অপ্রস্তুত রেখে' পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কাছে 'আত্মসমর্পণ' করেছেন ইত্যাদি। এই জ্ঞান পাপী অথবা পাকিস্তানের ভাবাদর্শের প্রেতাত্মারা অথবা ছদ্ম বিপস্নবীরা কার্যত একই পঙক্তিভুক্ত। বিদ্বেষ ও মিথ্যাচারই তাদের একমাত্র পুঁজি।
ইতিহাসের বাস্তব ঘটনাবলীই প্রমাণ করেছে, বঙ্গবন্ধু ওই ২০ মিনিটের এক ভাষণের মাধ্যমেই বাঙালি জাতিকে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছেন।
বিংশ শতাব্দীর জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্ট্র্যাটেজিশিয়ান হিসেবে তিনি রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদর্শিতা নিয়ে বিপস্নবের শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র দুটি উপায়ের মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়ে ইতিহাসের প্রকৃত নায়কের ভূমিকায় বসিয়েছেন বাংলাদেশের মানুষকে। একদিকে তিনি খোলা রেখেছেন শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার পথ; অন্যদিকে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য দেশবাসীকে বলেছেন, "তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক।ঃ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলঃ।"
এ কথা অনিস্বীকার্য, বস্তুত ৭ মার্চের ভাষণেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আনুষ্ঠানিকতার দিকটি বাদ দিলে ৭ মার্চই হতে পারতো আমাদের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু, ওই যে বললাম, স্ট্র্যাটিজিক কারণেই তিনি ৭ মার্চ চূড়ান্ত স্বাধীনতার ঘোষণাটি দেননি। তবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' বলে তিনি বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের লক্ষ্যটি যে কী তা সমগ্র বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী অন্যান্য দেশের থেকে পৃথক। আলজেরিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম এমনকি আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমার প্রভৃতি দেশ সুদীর্ঘ সময় জুড়ে গোপনে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিয়েছে, গেরিলা যুদ্ধ করেছে এবং বহু বছরব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশে প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের চিন্তা যে ছিল না তা নয়। বঙ্গবন্ধু সেই ষাটের দশকের গোড়া থেকেই ছাত্রদের মধ্যে 'নিউক্লিয়াস' গড়ে তোলার যেমন উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তেমনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি তরুণ অফিসার ও জোয়ানদের সংগঠিত করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এজন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে মনে করে গোপনে আগরতলা সফর করে ভারত সরকারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন। যার জন্য তাকে আগরতলা মামলার এক নম্বর আসামি হয়ে ক্যান্টনমেন্টে বিচার প্রহসনের নামে মৃতু্যর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছিল। আলজেরিয়া বা ভিয়েতনামের মতো গোপনে নিজাব 'জাতীয় মুক্তিফৌজ' গড়ে তোলার সময় বা সুযোগ তিনি পাননি। ফলে ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থানের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার রণকৌশল পরিবর্তন করেন।
আগেই বলেছি তিনি সংগ্রামের আইনসম্মত শান্তিপূর্ণ পথের সাথে সশস্ত্র সংগ্রামের কৌশলের মিশ্রণ ঘটান। প্রথমে ইয়াহিয়া খানের সামরিক আইনের আওতায় 'লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক' বা এল এফ ও মেনেই তিনি সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। 'অতি বিপস্নবী' মাওলানা ভাষানী এবং তার দল ন্যাপ (ভাসানী) এল এফ ও-র মধ্যে নির্বাচন নয় বলে ১৯৭০ সালের নির্বাচন বর্জন করেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষের মেজাজ, তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তাই প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে ওই নির্বাচনকে তিনি ৬-দফার পক্ষে গণভোট হিসেবে ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের মানুষ ওই গণভোটে শেখ মুজিবকে তাদের অবিসংবাদিত নেতা এবং আওয়ামী লীগকে জাতির প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র দল হিসেবে রায় দেয়।
নির্বাচনের ওই ফলাফল বঙ্গবন্ধু এবং তার দলকে বাঙালিদের পক্ষে কথা বলার একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়। এমনকি আওয়ামী লীগ আবিভর্ূত হয় পাকিস্তানের একক বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে। নির্বাচনের রায় এবং বৈধ প্রতিনিধিত্বের এই উপাদানটিই পরবর্তী সংগ্রামের নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের সভা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার পর বাংলাদেশের মানুষ বুঝে নেয় পাকিস্তানের কাঠামোয় বাঙালির স্বাধীকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আর কোনো সুযোগ নেই। ১ মার্চ থেকেই স্বতঃস্ফূর্ত আওয়াজ ওঠে, 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর'। এরপর দ্রুত কয়েকটি নাটকীয় ঘটনা ঘটে যায়। বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন হয়। স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ হয়। আমার সোনার বাংলা স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হবে বলে ঘোষিত হয়। এ সবকিছুই হয় বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নিয়ে। অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণার পর বাংলাদেশ কার্যত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে। ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কতর্ৃত্ব থাকে না। অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনা কর্মকর্তা, জোয়ান, বিডিআর, পুলিশ ও আনসাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাক্তন সৈনিক সংস্থার ব্যানারে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করার ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসার ও জেয়ানরাও গোপনে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করে। তারা স্পষ্টভাবেই সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতির কথা- বিদ্রোহের কথা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দেয়। জনগণের বিপস্নবী মেজাজ এবং একটা সশস্ত্র গণঅভু্যত্থানের সম্ভাবনার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত হয়ে যান। এরই পটভূমিতে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র গণঅভু্যত্থানের দুটি পথ খোলা রেখে দেশবাসীকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান। শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র সংগ্রামের এক অনবদ্য শিল্পরূপের সমাহার ছিল বঙ্গবন্ধুর চিন্তায়, কাজে, রণনীতি ও রণকৌশলে। বঙ্গবন্ধু তৎকালীন বিশ্ব বাস্তবতা, দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণের প্রতিকূলতা, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে নেতৃত্বদানে আওয়ামী লীগের মতো গণভিত্তিক দলের সীমাবদ্ধতা (রেজিমেন্টেড নয় বলে), সশস্ত্রযুদ্ধের পশ্চাৎভূমি হিসেবে প্রতিবেশী ভারতের দীর্ঘমেয়াদে দায় গ্রহণের সক্ষমতা, দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে বাংলাদেশের টিকে থাকার সক্ষমতা এবং সর্বোপরি ভারত দ্বারা বিচ্ছিন্ন পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের (অর্থাৎ আজকের পাকিস্তানের) সামরিক বাহিনী কতর্ৃক বাংলাদেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদে দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখার অসামর্থ্য প্রভৃতি বিষয় বঙ্গবন্ধু বিবেচনায় নিয়েছিলেন বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আমার এই বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি হলো, বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য জনগণকে প্রস্তুত থাকার কথা বললেও তিনি কিন্তু আলজেরিয়া বা ভিয়েতনামের মতো ক্লাসিক্যাল গেরিলা যুদ্ধের কথা, মুক্তাঞ্চল গঠন অথবা 'জাতীয় মুক্তিবাহিনী' গঠনের কোন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেননি। বরং তার ভাষণে প্রয়োজনে সশস্ত্র গণ-প্রতিরোধ বা গণযুদ্ধের কথাই প্রকারান্তরে ঘুরে-ফিরে এসেছে। বস্তুত ৭ মার্চের পর বাংলাদেশের মানুষ সে প্রস্তুতিই নিয়েছে।
২৬ মার্চের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে '১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ', স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার (মুজিব নগর সরকার) গঠন, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গঠন, গেরিলা যুদ্ধের জন্য মুক্তিবাহিনী গঠনসহ বিভিন্ন অক্সিলারি বাহিনী গঠন, দেশকে কয়েকটি সেক্টরে বিভক্ত করে সামরিক অভিযান পরিচালনাসহ সবকিছুই হয়েছে। এগুলো ছিল একটি স্বাধীন-জাতি-রাষ্ট্র গঠনের আবশ্যিক পূর্বশর্ত।
কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অন্যান্য দেশের মতো দীর্ঘায়িত হয়নি। মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে আমাদের দেশ হানাদারমুক্ত হয়। অনন্যসাধারণ আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তাই অন্য কোন দেশের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রামের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। সিপিবি, ন্যাপ প্রভৃতি দল মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে বলে তত্ত্বগতভাবে এবং বাস্তবেও বিশ্বাস করতো। তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে কনভেনশনাল আইডিয়া আর ক্লাসিক্যাল মুক্তিযুদ্ধ (ভিয়েতনাম, লাওস, কম্পোচিয়া অথবা আলজেরিয়ার মতো)। বঙ্গবন্ধু কিন্তু ঠিকই বুঝেছিলেন, যদি ব্যাপারটা যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায় তাহলে তা কোন ক্ল্যাসিক্যাল কনভেনশনাল মুক্তিযুদ্ধ হবে না। এটা হবে জনগণের সশস্ত্র গণঅভু্যত্থান। তা-ই ঘটেছিল ১৯৭১-এ। এই সশস্ত্র গণঅভু্যত্থানটি সাসটেইন করেছে ৯ মাস। সত্য বটে চূড়ান্ত পর্বে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ভারতীয় মিত্রবাহিনী। কিন্তু সেটি ছিল ঘটনাবলীর লজিক্যাল সমাপনী। তবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে প্রদত্ত সশস্ত্র গণঅভু্যত্থানের দিক-নির্দেশনা না থাকলে এবং বাংলাদেশের মানুষ তার জন্য অকাতরে জীবন না দিলে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন ছিল অসম্ভব।
[লেখক: রাজনীতিক]
পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে আসে। আবেগের তন্ত্রীতে যেখানে ঝঙ্কার তোলে, সেখানেই সমুদ্রগর্জনে গগনবিদারী শেস্নাগান ওঠে। মাত্র ২০ মিনিটের ভাষণ শেষ হয় এই কথা বলে, 'ঃএবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।' ব্যস, এটুকুই। ওই বিশ মিনিটেই নির্ধারিত হয়ে যায় বাংলাদেশের ভাগ্য এবং সংগ্রামের চরিত্র ও লক্ষ্য। আর ওই ২০ মিনিটের বক্তৃতায়ই বাংলাদেশের মানুষ পেয়ে যায় ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশনা।
মাত্র ওই ২০ মিনিটের বক্তৃতায় বাঙালি জাতির হাজার বছরের প্রতীক্ষার পালা শেষ হয়ে যায়। তারা জেনে যায় তাদের লক্ষ্য কী, তাদের কী করতে হবে। "আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন আরও রক্ত দেব- কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।" অথবা তার আগের উচ্চারণ, "আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।" কী ছিল না ওই বক্তৃতায়? যেসব মতলববাজ অথবা জ্ঞানপাপীরা ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে খাটো করতে চান অথবা তাকে অস্বীকার করতে চান তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। ওরা পাকিস্তান ভাঙার যন্ত্রণাটার কিছুটা উপশমের জন্য ইতিহাসের এক খলনায়ককে বঙ্গবন্ধুর স্থলাভিষিক্ত করতে গিয়ে নিজেরাই উপহাসের পাত্র হয়ে গেছেন। কিন্তু আরও কিছু 'মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের' কলম বিপস্নবী আছেন, যারা বলতে চান, 'স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের জন্য শেখ মুজিবের কোন প্রস্তুতি ছিল না। তিনি জনগণকে অপ্রস্তুত রেখে' পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কাছে 'আত্মসমর্পণ' করেছেন ইত্যাদি। এই জ্ঞান পাপী অথবা পাকিস্তানের ভাবাদর্শের প্রেতাত্মারা অথবা ছদ্ম বিপস্নবীরা কার্যত একই পঙক্তিভুক্ত। বিদ্বেষ ও মিথ্যাচারই তাদের একমাত্র পুঁজি।
ইতিহাসের বাস্তব ঘটনাবলীই প্রমাণ করেছে, বঙ্গবন্ধু ওই ২০ মিনিটের এক ভাষণের মাধ্যমেই বাঙালি জাতিকে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছেন।
বিংশ শতাব্দীর জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্ট্র্যাটেজিশিয়ান হিসেবে তিনি রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদর্শিতা নিয়ে বিপস্নবের শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র দুটি উপায়ের মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়ে ইতিহাসের প্রকৃত নায়কের ভূমিকায় বসিয়েছেন বাংলাদেশের মানুষকে। একদিকে তিনি খোলা রেখেছেন শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার পথ; অন্যদিকে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য দেশবাসীকে বলেছেন, "তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক।ঃ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলঃ।"
এ কথা অনিস্বীকার্য, বস্তুত ৭ মার্চের ভাষণেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আনুষ্ঠানিকতার দিকটি বাদ দিলে ৭ মার্চই হতে পারতো আমাদের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু, ওই যে বললাম, স্ট্র্যাটিজিক কারণেই তিনি ৭ মার্চ চূড়ান্ত স্বাধীনতার ঘোষণাটি দেননি। তবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' বলে তিনি বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের লক্ষ্যটি যে কী তা সমগ্র বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী অন্যান্য দেশের থেকে পৃথক। আলজেরিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম এমনকি আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমার প্রভৃতি দেশ সুদীর্ঘ সময় জুড়ে গোপনে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিয়েছে, গেরিলা যুদ্ধ করেছে এবং বহু বছরব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশে প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের চিন্তা যে ছিল না তা নয়। বঙ্গবন্ধু সেই ষাটের দশকের গোড়া থেকেই ছাত্রদের মধ্যে 'নিউক্লিয়াস' গড়ে তোলার যেমন উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তেমনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি তরুণ অফিসার ও জোয়ানদের সংগঠিত করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এজন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে মনে করে গোপনে আগরতলা সফর করে ভারত সরকারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন। যার জন্য তাকে আগরতলা মামলার এক নম্বর আসামি হয়ে ক্যান্টনমেন্টে বিচার প্রহসনের নামে মৃতু্যর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছিল। আলজেরিয়া বা ভিয়েতনামের মতো গোপনে নিজাব 'জাতীয় মুক্তিফৌজ' গড়ে তোলার সময় বা সুযোগ তিনি পাননি। ফলে ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থানের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার রণকৌশল পরিবর্তন করেন।
আগেই বলেছি তিনি সংগ্রামের আইনসম্মত শান্তিপূর্ণ পথের সাথে সশস্ত্র সংগ্রামের কৌশলের মিশ্রণ ঘটান। প্রথমে ইয়াহিয়া খানের সামরিক আইনের আওতায় 'লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক' বা এল এফ ও মেনেই তিনি সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। 'অতি বিপস্নবী' মাওলানা ভাষানী এবং তার দল ন্যাপ (ভাসানী) এল এফ ও-র মধ্যে নির্বাচন নয় বলে ১৯৭০ সালের নির্বাচন বর্জন করেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষের মেজাজ, তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তাই প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে ওই নির্বাচনকে তিনি ৬-দফার পক্ষে গণভোট হিসেবে ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের মানুষ ওই গণভোটে শেখ মুজিবকে তাদের অবিসংবাদিত নেতা এবং আওয়ামী লীগকে জাতির প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র দল হিসেবে রায় দেয়।
নির্বাচনের ওই ফলাফল বঙ্গবন্ধু এবং তার দলকে বাঙালিদের পক্ষে কথা বলার একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়। এমনকি আওয়ামী লীগ আবিভর্ূত হয় পাকিস্তানের একক বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে। নির্বাচনের রায় এবং বৈধ প্রতিনিধিত্বের এই উপাদানটিই পরবর্তী সংগ্রামের নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের সভা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার পর বাংলাদেশের মানুষ বুঝে নেয় পাকিস্তানের কাঠামোয় বাঙালির স্বাধীকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আর কোনো সুযোগ নেই। ১ মার্চ থেকেই স্বতঃস্ফূর্ত আওয়াজ ওঠে, 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর'। এরপর দ্রুত কয়েকটি নাটকীয় ঘটনা ঘটে যায়। বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন হয়। স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ হয়। আমার সোনার বাংলা স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হবে বলে ঘোষিত হয়। এ সবকিছুই হয় বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নিয়ে। অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণার পর বাংলাদেশ কার্যত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে। ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কতর্ৃত্ব থাকে না। অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনা কর্মকর্তা, জোয়ান, বিডিআর, পুলিশ ও আনসাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাক্তন সৈনিক সংস্থার ব্যানারে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করার ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসার ও জেয়ানরাও গোপনে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করে। তারা স্পষ্টভাবেই সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতির কথা- বিদ্রোহের কথা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দেয়। জনগণের বিপস্নবী মেজাজ এবং একটা সশস্ত্র গণঅভু্যত্থানের সম্ভাবনার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত হয়ে যান। এরই পটভূমিতে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র গণঅভু্যত্থানের দুটি পথ খোলা রেখে দেশবাসীকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান। শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র সংগ্রামের এক অনবদ্য শিল্পরূপের সমাহার ছিল বঙ্গবন্ধুর চিন্তায়, কাজে, রণনীতি ও রণকৌশলে। বঙ্গবন্ধু তৎকালীন বিশ্ব বাস্তবতা, দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণের প্রতিকূলতা, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে নেতৃত্বদানে আওয়ামী লীগের মতো গণভিত্তিক দলের সীমাবদ্ধতা (রেজিমেন্টেড নয় বলে), সশস্ত্রযুদ্ধের পশ্চাৎভূমি হিসেবে প্রতিবেশী ভারতের দীর্ঘমেয়াদে দায় গ্রহণের সক্ষমতা, দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে বাংলাদেশের টিকে থাকার সক্ষমতা এবং সর্বোপরি ভারত দ্বারা বিচ্ছিন্ন পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের (অর্থাৎ আজকের পাকিস্তানের) সামরিক বাহিনী কতর্ৃক বাংলাদেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদে দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখার অসামর্থ্য প্রভৃতি বিষয় বঙ্গবন্ধু বিবেচনায় নিয়েছিলেন বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আমার এই বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি হলো, বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য জনগণকে প্রস্তুত থাকার কথা বললেও তিনি কিন্তু আলজেরিয়া বা ভিয়েতনামের মতো ক্লাসিক্যাল গেরিলা যুদ্ধের কথা, মুক্তাঞ্চল গঠন অথবা 'জাতীয় মুক্তিবাহিনী' গঠনের কোন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেননি। বরং তার ভাষণে প্রয়োজনে সশস্ত্র গণ-প্রতিরোধ বা গণযুদ্ধের কথাই প্রকারান্তরে ঘুরে-ফিরে এসেছে। বস্তুত ৭ মার্চের পর বাংলাদেশের মানুষ সে প্রস্তুতিই নিয়েছে।
২৬ মার্চের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে '১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ', স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার (মুজিব নগর সরকার) গঠন, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গঠন, গেরিলা যুদ্ধের জন্য মুক্তিবাহিনী গঠনসহ বিভিন্ন অক্সিলারি বাহিনী গঠন, দেশকে কয়েকটি সেক্টরে বিভক্ত করে সামরিক অভিযান পরিচালনাসহ সবকিছুই হয়েছে। এগুলো ছিল একটি স্বাধীন-জাতি-রাষ্ট্র গঠনের আবশ্যিক পূর্বশর্ত।
কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অন্যান্য দেশের মতো দীর্ঘায়িত হয়নি। মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে আমাদের দেশ হানাদারমুক্ত হয়। অনন্যসাধারণ আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তাই অন্য কোন দেশের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রামের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। সিপিবি, ন্যাপ প্রভৃতি দল মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে বলে তত্ত্বগতভাবে এবং বাস্তবেও বিশ্বাস করতো। তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে কনভেনশনাল আইডিয়া আর ক্লাসিক্যাল মুক্তিযুদ্ধ (ভিয়েতনাম, লাওস, কম্পোচিয়া অথবা আলজেরিয়ার মতো)। বঙ্গবন্ধু কিন্তু ঠিকই বুঝেছিলেন, যদি ব্যাপারটা যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায় তাহলে তা কোন ক্ল্যাসিক্যাল কনভেনশনাল মুক্তিযুদ্ধ হবে না। এটা হবে জনগণের সশস্ত্র গণঅভু্যত্থান। তা-ই ঘটেছিল ১৯৭১-এ। এই সশস্ত্র গণঅভু্যত্থানটি সাসটেইন করেছে ৯ মাস। সত্য বটে চূড়ান্ত পর্বে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ভারতীয় মিত্রবাহিনী। কিন্তু সেটি ছিল ঘটনাবলীর লজিক্যাল সমাপনী। তবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে প্রদত্ত সশস্ত্র গণঅভু্যত্থানের দিক-নির্দেশনা না থাকলে এবং বাংলাদেশের মানুষ তার জন্য অকাতরে জীবন না দিলে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন ছিল অসম্ভব।
[লেখক: রাজনীতিক]
No comments:
Post a Comment