’পাখি ডাকা ছায়া ঢাকা’ টুঙ্গিপাড়ার ফুলে ফুলে ছাওয়া বঙ্গবনধুর সমাধিস্থলে দাঁড়িয়ে কত কথা, কত স্মৃতি মনে পড়ে আজ। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে এখানে শেষ ঘুমে শুয়ে আছেন আমাদের ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবনধু শেখ মুজিবুর রহমান। মনে হয়, গোটা বাংলাদেশ ঘুমিয়ে আছে বীরত্বগাথায় ভরপুর স্বাধীনতার সোনালি ইতিহাস বুকে জড়িয়ে। এখানে এই নদীর কলতানে মুখরিত বনবীথির ছায়াতলে যার পরম গৌরবের জন্ম, আবার এই মাটিতে রক্তাক্ত ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে তার শেষ বিশ্রাম। যে মহামানবের আজন্ম সাধনার সোনালি ফসল আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ, পঁয়ত্রিশ বছর আগে আগস্টের এক ভোরে তার রক্তে ভিজে গেছে বাংলার শ্যামল মাটি। কী নিদারুণ অবহেলায়, কী নির্মম উপেক্ষায় তাকে সমাহিত করা হয়েছিল, সে কথা ভাবতেও মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। বন্দুকঘেরা পরিবেশে মাত্র ১৮ জন গ্রামবাসী জানাজায় শরিক হতে পেরেছিল নিহত বঙ্গবনধুর। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির দাফনকার্য সম্পন্ন হয়েছিল ৫৭০ সাবান আর রিলিফের কাপড় দিয়ে।
অদূরে দাঁড়িয়ে অসহায় আর্তনাদে নীরবে চোখের পানি ফেলেছিল হাজার হাজার শোকাতুর মানুষ। অন্তিমযাত্রায় ভারতের মহাত্মা গানধী ও ইন্দিরা গানধীর মতো জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত ফুলে ফুলে ঢাকা তার কফিন পায়নি সামান্যতম রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। লাস্ট পোস্টে বিউগলে বেজে ওঠেনি শেষ বিদায়ের করুণ সুর। বঙ্গবনধুর যৌবনের উত্তাপ দিয়ে গড়া স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীর জাতীয় মাজারে জাতির জনকের সমাধির জন্য দু’গজ জমিও জুটল না। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার এতই বদনসিব যে, তার মরদেহ সমাহিত হলো রাজধানী থেকে অনেক দূরের অজগাঁ টুঙ্গিপাড়ায়। যেমন অযত্ন-অবহেলায় সমাহিত হয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে রাজধানী সান্তিয়াগো থেকে অনেক দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে চিলির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার মতোই বঙ্গবনধুর বুলেটবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ খুনিদের উল্লাস নৃত্যের মধ্য দিয়ে মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল টুঙ্গিপাড়ায়। হতবাক বিস্ময়ে শোকবিহবল বাংলাদেশের মানুষ পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টে প্রত্যক্ষ করলেন আরেক পলাশী ষড়যন্ত্রের পুনরাভিনয়। দেশপ্রেমিক সিরাজউদ্দৌলাকে নারীলোলুপ দুশ্চরিত্র, লম্পট শাসক বলে কত কলঙ্কের কালিমা লেপন করা হয়েছিল। বঙ্গবনধুও তখন খুনিদের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র হত্যাকারী, দুর্নীতিবাজ। তার হত্যাকারীদের ’সূর্য সৈনিক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসন থেকে। তার পরের ইতিহাসও সবার জানা। বঙ্গবনধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের পুরস্কৃত করা হলো নিরাপদে দেশ ত্যাগের ব্যবস্থা করে, বিদেশী দূতাবাসে বাংলাদেশের কূটনৈতিক পদমর্যাদা দিয়ে। বঙ্গবনধুর হত্যার বিচার রোধকারী ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে লাখো শহীদের রক্তমূল্যে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানের আইনে পরিণত করলেন মু্ক্তিযুদ্ধেরই একজন সেক্টর কমান্ডার জে. জিয়াউর রহমান।
এই সংবিধানেই আবার সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করা হলো তিরিশ লাখ শহীদের লাশের নিচে একাত্তরে সমাধিস্থ চিরাচরিত পাকিস্তানি মার্কা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সেই সুবাদে পুনর্বাসিত হলো স্বাধীনতার পরাজিত নরঘাতক শক্তি তথা পাকহানাদার বাহিনীর এ দেশীয় দোসররা। বন্দুক উঁচিয়ে সংবিধান থেকে হটিয়ে দেয়া হলো মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধগুলোকে। সুপরিকল্পিতভাবে ছুরি চালানো হলো স্বাধীনতার আদর্শের ওপর। নির্বাসনে পাঠানো হলো মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি জয় বাংলাকে। বিজয়ের নায়ককে হত্যা করে একে একে নস্যাৎ করা হলো স্বাধীনতার সুফলগুলো। বঙ্গবনধু-উত্তর বাংলাদেশ এভাবে উপহার পেলো হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি।
ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবনধু তো একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে গেলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে। উনিশ বছর যাবৎ তার বিরুদ্ধে অবিরাম ব্যবহৃত হলো চরিত্রহননের কত ছোরা। অবমূল্যায়নের নরুন দিয়ে বারে বারে ছেদন করা হলো তাকে। দেয়ালে টাঙ্গানো তার ছবি নামিয়ে ফেলা হলো চরম অপমানে। কতবার ছেঁড়া হলো ছবির মুজিবকে। পদদলিত করা হলো তার কত প্রতিকৃতি। স্বাধীনতা দিবসে, বিজয় দিবসে পাবলিক মিডিয়ায় তিনি অনুচ্চারিত নাম। রাষ্ট্রীয় উৎসব মঞ্চে স্বাধীনতা নাটক আছে অথচ এই নাটকের নায়ক যেন কেউ নেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণাস্থল পরিণত হলো শিশুপার্ক ও গাছগাছালির শোভায়। বঙ্গবনধুকে ভুলিয়ে দিতে শিশু-কিশোরদের পাঠ্যপুস্তক থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হলো তার অমর বীরত্বগাথার ইতিহাস। এভাবে পরিকল্পিতভাবে বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে করা হলো বিকৃত। ইতিহাস থেকে বঙ্গবনধুকে মাটিচাপা দেয়াও হয়েছিল তাকে ভুলিয়ে দেয়ার সুচতুর কৌশলে।
কিন্তু আমি তো দেখি আজ সমাধি থেকে জেগে ওঠা নতুন এক বঙ্গবনধুর বিশাল আবেদন। বাংলাদেশের মানচিত্রের সমানই যার অস্তিত্ব, চরিত্রহননের কোনো ছোরা দিয়ে তাকে কি নিধন করা গেছে? অবমূল্যায়নের কোনো নরুন দিয়ে ছেদন কী করা গেছে স্বাধীনতার এই বটবৃক্ষকে? না, শত ষড়যন্ত্র আর হাজারো চেষ্টার পরও মুজিব মরেননি। শারীরিকভাবে হত হলেও বঙ্গবনধু বেঁচে আছেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে। শাসকরা তাকে ভুলিয়ে দিতে কত ছলাকলার আশ্রয় নিলো। কিন্তু মুজিব নামের সমেমাহন আজ সারা বাংলায় জাগিয়ে তুলেছে এক নবজাগরণের ঢেউ।
জনতার বিবেকের আদালতে মুজিব হত্যার বিচার হয়ে গেছে। সেই আত্মস্বীকৃত খুনিরা শত আশ্রয়-প্রশ্রয়েও প্রটেকশন পায়নি জনতার কাছে। দেশজুড়ে জনগণের ধিক্কার আর ঘৃণাই আজ খুনিদের প্রাপ্য। বঙ্গবনধু মরেও বেঁচে আছেন। যত দিন এ বাংলায় চন্দ্র-সূর্য উদয় হবে, যত দিন এই জনপদে পাখির কলরব থাকবে, নদীর কলতান থাকবে, সাগরের গর্জন থাকবে, বিশ্বমানচিত্রে বাংলা নামে দেশ থাকবে, তত দিন বঙ্গবনধুও বেঁচে থাকবেন।
বঙ্গবনধুবিহীন বাংলাদেশ যেন আজ বিশ্বসাহিত্যের ইডিপাস ট্র্যাজেডির বাস্তবতা।
মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। বঙ্গবনধুর জন্য বাংলার ঘরে ঘরে অনুতাপ শুরু হয়ে গেছে। যেমন অনুতাপ হয়েছিল এ বাংলায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্য। যেমন অনুতাপ হয়েছিল রোমে সিজারের জন্য, গ্রিসে সক্রেটিসের জন্য। জায়ারে আজো লুমুম্বা হত্যার অভিশাপে জর্জরিত। গ্রানাডার মাটি হজম করেনি মরিস বিশপের রক্ত, চিলি হজম করেনি আলেন্দের রক্ত। বাংলাদেশের মাটি কি হজম করতে পারে মুজিবের রক্ত? এই বিখ্যাত লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে ওরা ভুলই করল। তারা জানে না, এই লাশ একদিন ঢাকায় ফিরে যাবে। তারা কি দেখছে না, কী করে অখ্যাত টুঙ্গিপাড়া গ্রাম বিখ্যাত হয়ে গেল শেখ মুজিবের লাশের বদৌলতে?
একদা নিথর নিস্তব্ধ অনধকার টুঙ্গিপাড়ায় এখন লাখো জনতার ঢল। জাতির জনকের জন্মোৎসবে দেখেছি অন্তহীন জনস্রোত জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়া অভিমুখে। বঙ্গবনধুর শাহাদত দিবস উপলক্ষে এবারো বাংলাদেশের সব রাস্তাই মিলে যাবে টুঙ্গিপাড়ার সাথে। শুধু কি জন্ম আর মৃত্যু দিবস? রোজ রোজ কত নর-নারী ও শিশু ছুটে যায় শেখ মুজিবের সমাধিস্থলে। টুঙ্গিপাড়া পরিণত হয়েছে এই জনপদের সব বিবেকবান, হৃদয়বান ও দেশপ্রেমিক মানুষের পবিত্র তীর্থস্থানে।
বঙ্গবনধু, আপনি এখানেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকুন। ঘাতকের বুলেটের চেয়েও আপনি আরো বলশালী। জাগ্রত জনতার হৃদয়ে রয়েছে আপনার জাতীয় মর্যাদার পাকা আসন। কবির ভাষায় ঃ
মুছিবে না চিহ্ন তার শত যুগান্তরে, অনন্তকালের মহা অনন্ত প্লাবনে।
লেখক ঃ প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
অদূরে দাঁড়িয়ে অসহায় আর্তনাদে নীরবে চোখের পানি ফেলেছিল হাজার হাজার শোকাতুর মানুষ। অন্তিমযাত্রায় ভারতের মহাত্মা গানধী ও ইন্দিরা গানধীর মতো জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত ফুলে ফুলে ঢাকা তার কফিন পায়নি সামান্যতম রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। লাস্ট পোস্টে বিউগলে বেজে ওঠেনি শেষ বিদায়ের করুণ সুর। বঙ্গবনধুর যৌবনের উত্তাপ দিয়ে গড়া স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীর জাতীয় মাজারে জাতির জনকের সমাধির জন্য দু’গজ জমিও জুটল না। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার এতই বদনসিব যে, তার মরদেহ সমাহিত হলো রাজধানী থেকে অনেক দূরের অজগাঁ টুঙ্গিপাড়ায়। যেমন অযত্ন-অবহেলায় সমাহিত হয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে রাজধানী সান্তিয়াগো থেকে অনেক দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে চিলির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার মতোই বঙ্গবনধুর বুলেটবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ খুনিদের উল্লাস নৃত্যের মধ্য দিয়ে মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল টুঙ্গিপাড়ায়। হতবাক বিস্ময়ে শোকবিহবল বাংলাদেশের মানুষ পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টে প্রত্যক্ষ করলেন আরেক পলাশী ষড়যন্ত্রের পুনরাভিনয়। দেশপ্রেমিক সিরাজউদ্দৌলাকে নারীলোলুপ দুশ্চরিত্র, লম্পট শাসক বলে কত কলঙ্কের কালিমা লেপন করা হয়েছিল। বঙ্গবনধুও তখন খুনিদের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র হত্যাকারী, দুর্নীতিবাজ। তার হত্যাকারীদের ’সূর্য সৈনিক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসন থেকে। তার পরের ইতিহাসও সবার জানা। বঙ্গবনধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের পুরস্কৃত করা হলো নিরাপদে দেশ ত্যাগের ব্যবস্থা করে, বিদেশী দূতাবাসে বাংলাদেশের কূটনৈতিক পদমর্যাদা দিয়ে। বঙ্গবনধুর হত্যার বিচার রোধকারী ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে লাখো শহীদের রক্তমূল্যে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানের আইনে পরিণত করলেন মু্ক্তিযুদ্ধেরই একজন সেক্টর কমান্ডার জে. জিয়াউর রহমান।
এই সংবিধানেই আবার সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করা হলো তিরিশ লাখ শহীদের লাশের নিচে একাত্তরে সমাধিস্থ চিরাচরিত পাকিস্তানি মার্কা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সেই সুবাদে পুনর্বাসিত হলো স্বাধীনতার পরাজিত নরঘাতক শক্তি তথা পাকহানাদার বাহিনীর এ দেশীয় দোসররা। বন্দুক উঁচিয়ে সংবিধান থেকে হটিয়ে দেয়া হলো মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধগুলোকে। সুপরিকল্পিতভাবে ছুরি চালানো হলো স্বাধীনতার আদর্শের ওপর। নির্বাসনে পাঠানো হলো মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি জয় বাংলাকে। বিজয়ের নায়ককে হত্যা করে একে একে নস্যাৎ করা হলো স্বাধীনতার সুফলগুলো। বঙ্গবনধু-উত্তর বাংলাদেশ এভাবে উপহার পেলো হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি।
ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবনধু তো একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে গেলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে। উনিশ বছর যাবৎ তার বিরুদ্ধে অবিরাম ব্যবহৃত হলো চরিত্রহননের কত ছোরা। অবমূল্যায়নের নরুন দিয়ে বারে বারে ছেদন করা হলো তাকে। দেয়ালে টাঙ্গানো তার ছবি নামিয়ে ফেলা হলো চরম অপমানে। কতবার ছেঁড়া হলো ছবির মুজিবকে। পদদলিত করা হলো তার কত প্রতিকৃতি। স্বাধীনতা দিবসে, বিজয় দিবসে পাবলিক মিডিয়ায় তিনি অনুচ্চারিত নাম। রাষ্ট্রীয় উৎসব মঞ্চে স্বাধীনতা নাটক আছে অথচ এই নাটকের নায়ক যেন কেউ নেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণাস্থল পরিণত হলো শিশুপার্ক ও গাছগাছালির শোভায়। বঙ্গবনধুকে ভুলিয়ে দিতে শিশু-কিশোরদের পাঠ্যপুস্তক থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হলো তার অমর বীরত্বগাথার ইতিহাস। এভাবে পরিকল্পিতভাবে বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে করা হলো বিকৃত। ইতিহাস থেকে বঙ্গবনধুকে মাটিচাপা দেয়াও হয়েছিল তাকে ভুলিয়ে দেয়ার সুচতুর কৌশলে।
কিন্তু আমি তো দেখি আজ সমাধি থেকে জেগে ওঠা নতুন এক বঙ্গবনধুর বিশাল আবেদন। বাংলাদেশের মানচিত্রের সমানই যার অস্তিত্ব, চরিত্রহননের কোনো ছোরা দিয়ে তাকে কি নিধন করা গেছে? অবমূল্যায়নের কোনো নরুন দিয়ে ছেদন কী করা গেছে স্বাধীনতার এই বটবৃক্ষকে? না, শত ষড়যন্ত্র আর হাজারো চেষ্টার পরও মুজিব মরেননি। শারীরিকভাবে হত হলেও বঙ্গবনধু বেঁচে আছেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে। শাসকরা তাকে ভুলিয়ে দিতে কত ছলাকলার আশ্রয় নিলো। কিন্তু মুজিব নামের সমেমাহন আজ সারা বাংলায় জাগিয়ে তুলেছে এক নবজাগরণের ঢেউ।
জনতার বিবেকের আদালতে মুজিব হত্যার বিচার হয়ে গেছে। সেই আত্মস্বীকৃত খুনিরা শত আশ্রয়-প্রশ্রয়েও প্রটেকশন পায়নি জনতার কাছে। দেশজুড়ে জনগণের ধিক্কার আর ঘৃণাই আজ খুনিদের প্রাপ্য। বঙ্গবনধু মরেও বেঁচে আছেন। যত দিন এ বাংলায় চন্দ্র-সূর্য উদয় হবে, যত দিন এই জনপদে পাখির কলরব থাকবে, নদীর কলতান থাকবে, সাগরের গর্জন থাকবে, বিশ্বমানচিত্রে বাংলা নামে দেশ থাকবে, তত দিন বঙ্গবনধুও বেঁচে থাকবেন।
বঙ্গবনধুবিহীন বাংলাদেশ যেন আজ বিশ্বসাহিত্যের ইডিপাস ট্র্যাজেডির বাস্তবতা।
মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। বঙ্গবনধুর জন্য বাংলার ঘরে ঘরে অনুতাপ শুরু হয়ে গেছে। যেমন অনুতাপ হয়েছিল এ বাংলায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্য। যেমন অনুতাপ হয়েছিল রোমে সিজারের জন্য, গ্রিসে সক্রেটিসের জন্য। জায়ারে আজো লুমুম্বা হত্যার অভিশাপে জর্জরিত। গ্রানাডার মাটি হজম করেনি মরিস বিশপের রক্ত, চিলি হজম করেনি আলেন্দের রক্ত। বাংলাদেশের মাটি কি হজম করতে পারে মুজিবের রক্ত? এই বিখ্যাত লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে ওরা ভুলই করল। তারা জানে না, এই লাশ একদিন ঢাকায় ফিরে যাবে। তারা কি দেখছে না, কী করে অখ্যাত টুঙ্গিপাড়া গ্রাম বিখ্যাত হয়ে গেল শেখ মুজিবের লাশের বদৌলতে?
একদা নিথর নিস্তব্ধ অনধকার টুঙ্গিপাড়ায় এখন লাখো জনতার ঢল। জাতির জনকের জন্মোৎসবে দেখেছি অন্তহীন জনস্রোত জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়া অভিমুখে। বঙ্গবনধুর শাহাদত দিবস উপলক্ষে এবারো বাংলাদেশের সব রাস্তাই মিলে যাবে টুঙ্গিপাড়ার সাথে। শুধু কি জন্ম আর মৃত্যু দিবস? রোজ রোজ কত নর-নারী ও শিশু ছুটে যায় শেখ মুজিবের সমাধিস্থলে। টুঙ্গিপাড়া পরিণত হয়েছে এই জনপদের সব বিবেকবান, হৃদয়বান ও দেশপ্রেমিক মানুষের পবিত্র তীর্থস্থানে।
বঙ্গবনধু, আপনি এখানেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকুন। ঘাতকের বুলেটের চেয়েও আপনি আরো বলশালী। জাগ্রত জনতার হৃদয়ে রয়েছে আপনার জাতীয় মর্যাদার পাকা আসন। কবির ভাষায় ঃ
মুছিবে না চিহ্ন তার শত যুগান্তরে, অনন্তকালের মহা অনন্ত প্লাবনে।
লেখক ঃ প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
No comments:
Post a Comment