একবার নিজ এলাকার কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায় বঙ্গবন্ধু একটি অনুরোধ করেছিলেন। অনুরোধটি ছিল এমন- ‘আমি মরে গেলে তোরা আমাকে টুঙ্গিপাড়ায় কবর দিবি। আমার কবরের ওপর একটি টিনের চোঙা লাগিয়ে দিবি।’ একজন তাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘টুঙ্গিপাড়ায় আপনার কবরের কথাটি না হয় বুঝলাম, টুঙ্গিপাড়া আপনার জন্মস্থান। কিন্তু এই চোঙা লাগানোর ব্যাপারটি তো বুঝলাম না।’
বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘টুঙ্গিপাড়ায় শুয়ে আমি পাখির ডাক শুনব, ধানের সোঁদা গন্ধ পাব। আর চোঙা লাগাতে বলছি এজন্য যে, এই চোঙা ফুঁকে একদিন শেখ মুজিব নামের এক কিশোর ‘বাঙালি’ ‘বাঙালি’ বলতে বলতে রাজনীতি শুরু করেছিল।’ বঙ্গবন্ধু নিজেকে জানতেন, বাঙালিকেও চিনতেন; শৈশব থেকে শুরু করে আজীবন তিনি এই বাঙালিলগ্ন রাজনীতিই করেছেন। শৈশবে বাবা-মার আদরের খোকা এই বাঙালিলগ্ন রাজনীতি করতে করতেই একদিন হয়ে ওঠে শেখ মুজিব, শেখ সাহেব এবং মুজিব ভাই। তারপর সময় গড়িয়ে ঊনসত্তরের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাঙালির দেয়া অভিধায় হলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর ঘটে গেল বাঙালির জীবনে এক বিরাট পর্বান্তর, বাঙালি জাতি ও রাষ্ট্রীয় সত্তায় ভূষিত হল, যার অনুঘটক হলেন এই বঙ্গবন্ধু। কাজেই তিনি আর শুধু বঙ্গবন্ধু রইলেন না, হয়ে উঠলেন জাতির জনক। বাঙালি জাতির নির্মাণ ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফসল, কিন্তু এই জাতির রাষ্ট্রীয় পরিচয়প্রাপ্তির জটিল ও কঠিন পরিক্রমায় অনুঘটক ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
কথায় বলে, উঠন্তি মুলো পত্তনেই চেনা যায়। বঙ্গবন্ধু তো তা-ই ছিলেন। তিনি যে নেতা হবেন, তার নেতৃত্ব যে বাঙালির জীবনে সবচেয়ে বড় বাঁকবদলটি ঘটাবে, তার প্রমাণ কিশোর বঙ্গবন্ধুর মধ্যেই পাওয়া গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুল পরিদর্শনে এসেছেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, সঙ্গে আছেন শিল্প ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুল পরিদর্শন শেষে তারা বেরিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু পথ আগলিয়ে দাঁড়িয়ে গেল এই খোকা বা শেখ মুজিবুর রহমান। সবাই হতবাক! শেরেবাংলা জিজ্ঞেস করলেন, তার কী কথা? উত্তর পেলেন, ছাত্রাবাসের ছাদ দিয়ে পানি পড়ে বহুদিন থেকে। মেরামতের ব্যবস্থা করে দিয়ে তবে তারা যেতে পারবেন। শেরেবাংলা জিজ্ঞেস করলেন, কত খরচ লাগবে? হিসাবটা শেখ মুজিব করে রেখেছিলেন। কাজেই উত্তর দিলেন ঝটপট- ১২শ’ টাকা। তাৎক্ষণিকভাবে অর্থ বরাদ্দ হল এবং এ কিশোরের সাহসিকতায় দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হল। ভবিষ্যতে এ সাহস অবয়ব ও গভীরতায় অনেক বিস্তৃত হয়েছিল বলেই শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনক হয়েছিলেন।
একবার গোপালগঞ্জ এলাকায় বেশ খরা হয়েছিল। ক্ষেতে ফসল হয়নি। কৃষকের ভাগ্যও পুড়েছিল। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে তিনি ক’জন হতভাগ্য কৃষককে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তিনি প্রত্যেককে দিয়ে দিলেন কিছু ধান ও চাল, কাউকে কিছু না বলেই। বাবা বাড়ি ফিরে ব্যাপারটি জেনে খোকাকে কিছু গালমন্দ করলেন। কিন্তু খোকার বেশ দৃঢ় উত্তর ছিল- ‘আমাদের তো ধান ও চাল ভালোই আছে, তা থেকে ওদের সামান্য দিলাম। কারণ ওদেরও পেট আছে, ওদেরও ক্ষিদে আছে।’ দরিদ্র মানুষের প্রতি বা মানুষের প্রতি এই মমত্ববোধই জনতালগ্ন নেতার বড় গুণ। আর এই গুণই তাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিতে উন্নীত করেছে।
একবার একজন বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী?’ বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি।’ এই ভালোবাসাই ছিল তার বড় গুণ। কিন্তু এই অন্ধ ভালোবাসাই ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট তার জীবনকে সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। কিন্তু ব্যক্তি মুজিব হারিয়ে গেলেও জনতার বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘টুঙ্গিপাড়ায় শুয়ে আমি পাখির ডাক শুনব, ধানের সোঁদা গন্ধ পাব। আর চোঙা লাগাতে বলছি এজন্য যে, এই চোঙা ফুঁকে একদিন শেখ মুজিব নামের এক কিশোর ‘বাঙালি’ ‘বাঙালি’ বলতে বলতে রাজনীতি শুরু করেছিল।’ বঙ্গবন্ধু নিজেকে জানতেন, বাঙালিকেও চিনতেন; শৈশব থেকে শুরু করে আজীবন তিনি এই বাঙালিলগ্ন রাজনীতিই করেছেন। শৈশবে বাবা-মার আদরের খোকা এই বাঙালিলগ্ন রাজনীতি করতে করতেই একদিন হয়ে ওঠে শেখ মুজিব, শেখ সাহেব এবং মুজিব ভাই। তারপর সময় গড়িয়ে ঊনসত্তরের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাঙালির দেয়া অভিধায় হলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর ঘটে গেল বাঙালির জীবনে এক বিরাট পর্বান্তর, বাঙালি জাতি ও রাষ্ট্রীয় সত্তায় ভূষিত হল, যার অনুঘটক হলেন এই বঙ্গবন্ধু। কাজেই তিনি আর শুধু বঙ্গবন্ধু রইলেন না, হয়ে উঠলেন জাতির জনক। বাঙালি জাতির নির্মাণ ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফসল, কিন্তু এই জাতির রাষ্ট্রীয় পরিচয়প্রাপ্তির জটিল ও কঠিন পরিক্রমায় অনুঘটক ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
কথায় বলে, উঠন্তি মুলো পত্তনেই চেনা যায়। বঙ্গবন্ধু তো তা-ই ছিলেন। তিনি যে নেতা হবেন, তার নেতৃত্ব যে বাঙালির জীবনে সবচেয়ে বড় বাঁকবদলটি ঘটাবে, তার প্রমাণ কিশোর বঙ্গবন্ধুর মধ্যেই পাওয়া গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুল পরিদর্শনে এসেছেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, সঙ্গে আছেন শিল্প ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুল পরিদর্শন শেষে তারা বেরিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু পথ আগলিয়ে দাঁড়িয়ে গেল এই খোকা বা শেখ মুজিবুর রহমান। সবাই হতবাক! শেরেবাংলা জিজ্ঞেস করলেন, তার কী কথা? উত্তর পেলেন, ছাত্রাবাসের ছাদ দিয়ে পানি পড়ে বহুদিন থেকে। মেরামতের ব্যবস্থা করে দিয়ে তবে তারা যেতে পারবেন। শেরেবাংলা জিজ্ঞেস করলেন, কত খরচ লাগবে? হিসাবটা শেখ মুজিব করে রেখেছিলেন। কাজেই উত্তর দিলেন ঝটপট- ১২শ’ টাকা। তাৎক্ষণিকভাবে অর্থ বরাদ্দ হল এবং এ কিশোরের সাহসিকতায় দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হল। ভবিষ্যতে এ সাহস অবয়ব ও গভীরতায় অনেক বিস্তৃত হয়েছিল বলেই শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনক হয়েছিলেন।
একবার গোপালগঞ্জ এলাকায় বেশ খরা হয়েছিল। ক্ষেতে ফসল হয়নি। কৃষকের ভাগ্যও পুড়েছিল। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে তিনি ক’জন হতভাগ্য কৃষককে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তিনি প্রত্যেককে দিয়ে দিলেন কিছু ধান ও চাল, কাউকে কিছু না বলেই। বাবা বাড়ি ফিরে ব্যাপারটি জেনে খোকাকে কিছু গালমন্দ করলেন। কিন্তু খোকার বেশ দৃঢ় উত্তর ছিল- ‘আমাদের তো ধান ও চাল ভালোই আছে, তা থেকে ওদের সামান্য দিলাম। কারণ ওদেরও পেট আছে, ওদেরও ক্ষিদে আছে।’ দরিদ্র মানুষের প্রতি বা মানুষের প্রতি এই মমত্ববোধই জনতালগ্ন নেতার বড় গুণ। আর এই গুণই তাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিতে উন্নীত করেছে।
একবার একজন বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী?’ বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি।’ এই ভালোবাসাই ছিল তার বড় গুণ। কিন্তু এই অন্ধ ভালোবাসাই ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট তার জীবনকে সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। কিন্তু ব্যক্তি মুজিব হারিয়ে গেলেও জনতার বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments:
Post a Comment